জাবির ‘ছাত্র-শৃঙ্খলা বিধি’; বিভিন্ন মহলের নিন্দার ঝড়

মোঃ রায়হান চৌধুরী, জাবি প্রতিনিধি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সংশোধিত অধ্যাদেশে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নতুন দুটি ধারা। আর এ নিয়ে বইছে নিন্দার ঝড়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা বলছেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেই ধারা দুটি যুক্ত করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশোধিত অধ্যাদেশের ৫ এর (ঞ) নং ধারায় বলা হয়েছে, কোন ছাত্র/ছাত্রী অসত্য এবং তথ্য বিকৃত করে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কোন সংবাদ বা প্রতিবেদন স্থানীয়/জাতীয়/আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যমে/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ/প্রচার করা বা উক্ত কাজে সহযোগিতা করতে পারবে না।

অধ্যাদেশের ৫ এর (থ) নং ধারায় বলা হয়েছে, কোন ছাত্র/ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র/ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর উদ্দেশ্যে টেলিফোন, মোবাইল, ই-মেইল, ইন্টানেটের মাধ্যমে কোন অশ্লীল বার্তা বা অসৌজন্যমূলক বার্তা প্রেরণ অথবা উত্যক্ত করবে না।

অধ্যাদেশ মতে, ধারা দুটির ব্যত্যয় ঘটলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের চোখে ‘অসদাচরণ’ বলে গণ্য হবে। এজন্য লঘু শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, সতর্কীকরণ এবং গুরু শাস্তি হিসেবে আজীবন বহিষ্কার, বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কার ও পাঁচ হাজার টাকার উর্ধ্বে যেকোনও পরিমাণ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে উচ্চ আদালত এক রায়ের পর্যবেক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা বিধিকে ‘দুর্বল ও সেকেলে’ উল্লেখ করে তা হালনাগাদের পরামর্শ দেয়। শৃঙ্খলাবিধির প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করতে ওই বছরের ১৬ মে তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আবুল হোসেনকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির হালনাগাদ করা শৃঙ্খলাবিধি গত ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাদেশ হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে।

অধ্যাদেশে অসত্য, তথ্য বিকৃতি, অশালীন বার্তা বা অসৌজন্যতামুলক বার্তার কোন সংজ্ঞা কিংবা ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়নি। ফলে ধারা দুটি নিপীড়নমূলক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে অসত্য কিংবা বিকৃত তথ্য প্রকাশ বা ছড়ানোর বিষয়ে যথাযথ আইন রয়েছে। এরপরেও এই ধরনের ধারা সংযোজন আপাতঃদৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন কিছু গোপন করার কিংবা গোপন রাখার প্রয়াস ছাড়া কিছুই নয় মন্তব্য করেছে বিভিন্ন মহল।

এদিকে নতুন যুক্ত হওয়া দুটি ধারাকে অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ৩২ ধারা এবং আইসিটি আইনের অধুনালুপ্ত ৫৭ ধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এটিকে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে সাংবাদিকতা বাঁধার মুখে পড়বে বলে সাংবাদিকরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

অধ্যাদেশ সম্পর্কে আইনজীবি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশের আচরণবিধি অংশে উল্লেখিত ৫(ঞ) এবং ৫(থ) ধারা দুটি বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ এর চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং অনুচ্ছেদ ৪০ এর পেশা বৃত্তির স্বাধীনতার পরিপন্থী। স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হুমকি হতে পারে এই ধারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। তাই এর অভ্যন্তরে কি ঘটছে তা জানবার অধিকার জনমানুষের রয়েছে। এ ধরণের আইন প্রণয়ন সেই স্বচ্ছতার পথে পরোক্ষ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, এই ধারা গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করার চেষ্টা। আমি এই প্রেক্ষিতে সবাইকে ফের জাকসু নিয়ে সরব হতে বলব। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ করার প্লাটফর্ম নাই। জাকসু থাকলে এইসব বিষয় প্রশাসনের সাথে বসে সমাধান করা যেত।

এদিকে এ দুটি ধারাকে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার আইন উল্লেখ করে ও তা বাতিলের দাবিতে বিবৃতি দিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট ও ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদ।

ধারা দুটি বাতিল করার আহ্বান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব-এর সভাপতি মো. মূসা ও সাধারণ সম্পাদক রাইয়ান বিন আমিন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ শৃঙ্খখলা বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশ ও প্রতিবাদের ক্ষেত্রকে সংকীর্ণ করার পায়তারা করছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মতামত প্রকাশ ও অন্যায়-দুর্নীতির প্রতিবাদ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি অসৎ উদ্দেশ্য সাধনকারীদের সুযোগ করে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ তারা আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদকর্মীদের জন্য এ আইন চরম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। বিশেষ করে এর ফলে অনুসন্ধান সাংবাদিকতার কোনো সুযোগ থাকবে না।’

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ধারা দুটিকে দুরভিসন্ধিমূলক, স্বেচ্ছাচারী, অগণতান্ত্রিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণকারী উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবী জানিয়ে বলা হয়, ‘মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আইন দিয়ে রুখতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এই আইন আরো বেশি ভয়ংঙ্কর। এটি রাষ্ট্রের বহু আলোচিত ৫৭ ধারারই নামান্তর। রাষ্ট্র যেমন একক ভাবে সকলের স্বাধীনতাকে চেপে ধরছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও ঠিক সেই পথেই হাটছে।’

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, ‘সংযোজিত ধারা প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের কন্ঠ চেপে ধরার অপচেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি বিরুদ্ধে যাতে শিক্ষার্থীদের কথা না বলে সে লক্ষ্যে এই ধারা তৈরী করা হয়েছে। এই ধারা শিগগিরই সংশোধন করার দাবি জানাই।’

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাবি সংসদের সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয় ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম অনিক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ‘তথ্য অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় আইন থাকার পরেও এইরকম আইন প্রণয়ণ অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক। এই কালা কানুন প্রণয়নের মাধ্যমে তথ্যের অসততা বা বিকৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়ার ফলে ক্ষমতার বিরুদ্ধে পর্যালোচনামূলক সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে।’ একই সাথে এই ধরণের শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডকে শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে কঠোরভাবে প্রতিহত করার হুঁশিয়ারিও প্রদান করা হয় বিবৃতিতে।

এদিকে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. আমির হোসেন বলেন, ‘নতুন বর্ষের প্রবেশিকা অনুষ্ঠান সামনে থাকায় বেশ তাড়াহুড়া করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ সেভাবে পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়নি। তবে কোনও পক্ষের আপত্তি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়েছে।’

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর