গল্প: বাষ্পশকট

– সব সময় মেজাজ এমন তেতে থাকে বুঝি?
– না, শুধু যখন কারো দায়িত্ব হীনতার জন্য কাঙ্ক্ষিত ট্রেনখানা মিস করতে হয়।
খানিক হেসে আবার বলল সৌমিত্র,
– আর হ্যা, ভাষা থেকে সব সময় শব্দটা একেবারে তুলে দিলে ভাল হতো। ওমন কিছু নেই আসলে।
ভেঙচি কেটে মেঘ বলল,
– নিজেকে ত্রুটিশুন্য নেপোলিয়ন ভাবেন বুঝি? শান্ত, নিরব, দক্ষ,,,ইত্যাদি।
– ঠিক তা না।
স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে হেসে ফেলল সৌমিত্র। সামনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা বাষ্পশকটের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল,
– আমি বোধহয় বাচ্চাদের মত আচরণ করে ফেলেছি।

ট্রেনের লম্বা কান ফাটানো হুইসেল ছেদ ফেলল ওদের কথোপকথনে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে দুজনেই ছুট লাগাল কম্পার্টমেন্টের দিকে। আসনে বসার সাথে সাথেই পেছন থেকে ঠেলা খাওয়া লোকের মত গোত্তা খেতে খেতে ছুটল ট্রেন। দুজনের আসন পাশাপাশি হওয়া স্বত্বেও জানালার পাশে মুখোমুখি বসল ওরা।
আসলে ওদের দেখা হবার মাত্র ঘন্টাখানেক পেরিয়েছে বোধহয়। কিন্তু তবুও বাষ্পশকটের কুউউউ ঝিকঝিক আওয়াজ, যাত্রীদের শোরগোল ওদের মিটিমিটি চোরাচোখে দৃষ্টি বিনিময়ে ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না।
এরপর দ্বিধা কাটিয়ে দুজনেই কিছু একটা বলার উদ্যোগ করে দুজনেই অস্ফুটস্বরে কিছু বলতে গিয়েই থেমে গেল। এহেন বিড়ম্বনা কাটতেই হা হা করে হেসে উঠল সৌমিত্র। অন্যদিকে আরক্ত হয়ে উঠল মেঘের কপোল। ব্যস্ত হয়ে আবার কথোপকথন শুরু করল মেঘ,
– বুঝলাম নিজের ছাড়া আর কারো ভুল পছন্দ করেন না আপনি।
– নিজের গুলোও পছন্দ করি না।
– এমন কিছু নেই যা পছন্দ করেন আপনি?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে খানিক চুপ থেকে সৌমিত্র বলল,
– পাহাড় ভাল্লাগে, সাগর ভাল্লাগে, হাওয়ায় উড়তে থাকা চুল দেখতে ভাল্লাগে, মাটির সোদা গন্ধ, কমলালেবুর ঝাঁঝ,মখমলের স্পর্শ। ভালো লাগে ঘোড়ার চাল দিয়ে প্রতিপক্ষের রাজা, মন্ত্রীকে একসাথে ধরতে পারলে, মনের মত কাজ ভালো লাগে, আর হ্যা মেয়েদের ভালো লাগে- বিশেষ করে যারা কম প্রশ্ন করে।
মুচকি হেসে এবার মেঘের দিকে তাকাল সৌমিত্র। চোখ মুখ কুচকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল মেঘ,
– আর অপছন্দ?
– স্বার্থপরতা, রাজনীতি, আর্ট ফিল্ম, কারো জন্য অপেক্ষা করা ইত্যাদি।
– আরো আছে নিশ্চই?
– বিস্তর।
– ইন্দ্রিয় নির্ভর মানুষ।
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেঘ।
বাইরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল দুজনেই। ক্ষনিকের দেখায় এত দীর্ঘ কথোপকথন জাল বিস্তার করেছে দুজনের মনেই।
বাষ্পশকটের কুউউ ঝিকঝিক আওয়াজ শুনতে শুনতে সৌমিত্র ভাবে জীবন তো এক বাষ্পশকট-ই বটে। এর একেকটা কম্পার্টমেন্ট যেন মানব জনমের একেকটা রিপু। স্টেশন গুলি যেন একেকটা বিশেষণ মাত্র। বাষ্পশকট যেমন চলতে চলতে একেকটা স্টেশন পেরিয়ে যায়, জীবন তেমনি পেরিয়ে যায় একেকটা অধ্যায়। প্রেম, পরিণয়, সংঘর্ষ, সততা, বিশ্বাসঘাতকতা, দায়িত্ব, সুখ, দুঃখ কি নেই জীবনে৷ কয়লা আর বাষ্পের সাহায্যে যেমন বাষ্পশকট চলে আমরাও তেমনি প্রতিনিয়ত জীবন চালাই খাদ্যে,,,উঁহু, স্রেফ খাদ্যেই কি আর জীবন চলে? চলে না, জীবন চলে অনুভূতি আর ভালোবাসায়।

বাষ্পশকট

হুইসেলের শব্দে ধ্যান ভাঙে দুজনের। অবাক হয়ে ভাবে মেঘ,
কি অদ্ভুতভাবে দুজন আলাদা হলেও গন্তব্য এক। দুজনেই নেমে পরে ট্রেন থেকে। পাশাপাশি দৃঢ় অথচ নিরব পদক্ষেপে হাটতে থাকে দুজন একসাথে। কিছুক্ষণের দেখা অথচ যেন জনম জনমের পরিচয়। কিছু সম্পর্কের সময় লাগে না, কিছু সম্পর্কের সৌজন্যতা লাগে না, কিছু সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি লাগে না।
চোখের ভাষাই যেন সব ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে।

হঠাৎ কোমল অথচ ছোট্ট একটা মুষ্টিবদ্ধ হাত চমক ভাঙায় দুজনেরই। সচকিত হয়ে থেমে দুজনেই চেয়ে দেখল শ্যামবর্ণ গায়ে হাটুকাটা প্যান্ট, দুটো বোতাম শুন্য শার্ট আর উষ্কখুষ্ক চুলের না জানি কোন জননীর এক তনয়। বিশ্বের সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ স্কন্ধে নিয়ে দুটো খুচরো পয়সা কিংবা অবহেলা মিশ্রিত খানিক হাওয়া মুষ্টিবদ্ধ করার নিমিত্তে হাত বাড়িয়ে অপলক চেয়ে আছে।
হঠাৎ সৌমিত্রের মনে হয় এই শিশু কোন জীবনের অধ্যায় পালন করছে?
স্বীয় প্রাণের প্রেম, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সংঘর্ষ, উদরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, জীবন রক্ষার দায়িত্ব নাকি সুখ স্বপ্নের অলীকত্ব ?
এগিয়ে এসে নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করে মেঘ,
– কি নাম তোমার।
– সৌমিত্র!
পেছন থেকে চমকে ওঠে গল্পের মূল চরিত্র। ভাবে হয়ত কোন মা আদর করে ছেলের এমন নাম রেখেছিল। তবে নামখানা বড়ই বেমানান এদের মত পথশিশুদের । এদের নাম হয়ত টুকাই, বলাই, ছোটো এসব ই মানায়। টিকটিকির পশ্চাৎদেশ থেকে খসে পরা লেজের মতই জন্মের পর থেকেই এদের নামের বাকি অংশ টাইটেল /সারনেম খসে পরে।
মেঘ জিজ্ঞেস করে,
– বাড়িতে কে কে আছে তোমার?
ছেলেটা মাথা নাড়ায়। ভাঙা কণ্ঠে বলে,
-কেউ নেই।
বোধহয় ছেলেটার জন্য করুনা হয় মেঘের। পেছন ফিরে সৌমিত্রের দিকে তাকায় মেঘ। অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,
– ছেলেটাকে কিছু খাইয়ে দিতে পারি আমরা!
সৌমিত্র নিরব।
কিন্তু এই নিরবতার ভুল অর্থ করল মেঘ। বিড়বিড় করে বলল,
– ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষের বুঝি মানবিকতা কম হয়।
হা হা করে হেসে উঠল সৌমিত্র। সে জানে মেঘ করুনা করতে চাইছে ছেলেটাকে। অথচ ছেলেটার করুনা অথবা সহানুভূতি প্রাপ্য নয়।মনে মনে একচোট হেসে ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে সৌমিত্র বলল,
– তোমাদের দুজনকেই দত্তক নিলে মানবিকতা দেখানো হবে তো?
মেঘ হকচকিয়ে যায়। মেঘ হয়তো জানে না ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষগুলো মানবিকতা জানে না। জানে মানবিকতাকে কর্তব্যের নাম দিতে।
এও বাষ্পশকটের মতই। কিছু লোক উঠে আবার কিছু লোক নেমে যায়। তাদের মন মানসিকতা আর কথোপকথনে পরিবেশ হয়ে উঠে জ্যান্ত আর ভিন্ন। জীবন ও তেমনি, কারো আগমনে জীবন ভরে যায় অনাবিল আনন্দে আবার কারো প্রস্থানে শুন্যতায় ভরে যায় হৃদয়।

সেদিনের পর থেকে থার্ড স্ট্রিটের পিতৃ মাতৃহীন সৌমিত্র সেনের বাড়িটা হয়ে ওঠে প্রতিবেশীদের কাছে তুমুল আলোচ্য বিষয়। সে বিয়ে করেছে বেশ ভালো কথা। কিন্তু বিয়ের পরেই ছেলে এলো কোত্থেকে? তাও এত বড় ছেলে আর ছেলের নামই বা বাপের নামে কিভাবে হয়? সৌমিত্র?
কিন্তু এর সমাধান তো আর আপনি, আমি ছাড়া কেউ জানে না, হা হা হা।

লেখক- শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ। নেত্রকোনা সরকারি কলেজ।

বার্তাবাজার/নিমফুল

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর