‘অ’ তে অনুভূতি, ক্ষুদ্র অনুভূতি

মাস্টারি করতে আমি অভ্যস্ত নই। ম্যাট্রিকের পরে নিছক আমার শিক্ষক একইসাথে মামার আদেশ পালন করতে উনার কোচিংয়ে পড়াতে যেতাম। পাটিগণিতে চিরদুর্বল আমি তখন যেন সেখান থেকে পার হতে পারলেই বাঁচি!

ক্লাস ফাইভের ‘৩০ দিনে একটা কাজ দিনে ৮ ঘন্টা করে ১১ জনে করতে পারলে, ২২ দিনে ৯ জনে সেই কাজ করতে দৈনিক কত ঘন্টা কাজ করতে হবে’ এমন অংকগুলো আমাকে দিয়ে কখনও হওয়া সম্ভব না। কারণ আমি পাটিগণিতে বরাবরই গোল্লা পেতাম। ক্লাস এইট পর্যন্ত কোনোমতে অংকে পাশ করতাম। নাইনে পাটিগণিত থেকে রেহাইয়ের পর আর পিছনে তাকাতে হয়নি৷

তো মামা আমাদের এলাকার নামকরা শিক্ষক৷ উনার প্রতিটা ব্যাচই স্পেশাল। আমাদের এলাকায় উনার স্টুডেন্টরা আলোড়ন তুলেছিল, শুধু আমি বাদে৷ আমি সেখানে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকতাম। লজ্জা পেতাম। ক্লাস ফাইভের সেই ব্যাচে (২০১২ সালে) একটা ছেলে ছিল। দুষ্টের শিরোমনি যাকে বলে। পড়া পারতো না বলে মামার রামধোলাই নিয়মিত খেতো। কিন্তু এতে তার লজ্জার বালাই নেই৷ বরং বহুগুন উৎসাহে দুষ্টুমি করতো। ছেলেটাকে দেখলে মায়া হতো। আহারে! আমিও ওর বয়সে মামার হাতে মার খেতাম প্রায়ই।

একদিন আমার জন্য জমাট বাঁধা এই কারাগার থেকে পালালাম৷ মামার সামনে পড়িনা। মামা রাস্তা দিয়ে হাটলে আমি উল্টা পথে যাই। অবশেষে উনি বুঝতে সক্ষম হলেন, আমি আর মাস্টারিতে নেই। সময় এসে গেল কলেজের ক্লাসে যাওয়ার। মহাআনন্দে কৈশোরের সর্বশেষ সময়টা জলাঞ্জলী দিতে ছুটলাম হোস্টেলে।

এরপর মাঝখানে ৬/৭ বছর কেটে গেলো৷ আমি আমার অল্পদিনের ছাত্রদের রাস্তাঘাটে দেখলে লজ্জা পাই৷ আনমনে চলে যাই। ওরা যদি সালাম দেয় সেই ভয়ে নিজেকে লুকাই। ক্যালকুলাস, ভেক্টর আর বিদ্যুতের কঠিনসব সার্কিটে মাস্টারি জীবনের স্বল্পদিনের অভিজ্ঞতা উবে গেল কর্পূরের মতন। জীবনের তাগিদে দিগ্বিদিক ছুটছি তখনও। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাটা আর মনে না করতে পারলেই যেন ভাল আমার জন্য।

দিন চলে যাচ্ছে। বেশ এলোমেলো ঝড়ে আনন্দেই চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে একদিন ফেসবুকে দুষ্ট ছেলেটা আমাকে রিকুয়েষ্ট দিল। টাইমলাইনে গিয়ে দেখি বেশ সাহিত্যরস আছে ওর। সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখে। ধারাবাহিক গল্প লিখে। ভাল লেগে গেল ওর লেখ গুলো।

একদিন আমাকে ম্যাসেজ করলো। কোনো ভণিতা না করেই জানতে চাইলো ‘গিটার শেখার জন্য বই ভাল হবে নাকি ট্রেইনার ভাল হবে’। আমি আমার স্বল্প জ্ঞানে তাকে পরামর্শ দিলাম ট্রেইনারের কাছে যেতে। কিছুদিন পর দেখি ছেলেটার টাইমলাইনে কয়েকটা ছবি পোস্ট করেছে। মেডিকেলের টেস্টের ছবি। ক্যাপশন ‘হাটুর হার ক্ষয় ও ক্যান্সার একইসাথে’। খুব কষ্ট পেলাম। কেন পেলাম জানিনা। ওতো আমার কাছের কেউ না! তবুও কষ্ট পেলাম।

এর পর আর ওই আইডি চালাইনি। বিভিন্ন কারণে নতুন একটা ফেসবুক আইডি খুললাম৷ এটাই চালাই নিয়মিত। কিছুক্ষন আগে আমার নতুন আইডিতে ওর আইডিটা সাজেস্ট হলো। প্রোফাইলে দেখলাম মাথা ন্যাড়া করা ছেলেটার ছবি। ভাবলাম হয়তো কোয়ারেন্টাইনের সাইড ইফেক্ট! কৌতুহলেই ঘুরে দেখলাম। বেশিরভাগ ছবিতেই ওর মাথায় চুল নেই। পরে দেখলাম ক্যামোথেরাপি নেয়ার ছবি।

বুঝলাম তার ক্যান্সার। কিন্তু সেই ভুবন ভুলানো হাসি লেগেই আছে। ভিডিওতে হাসির কথা বলছে। যেন ওর কোনো দুঃখই নেই। একটা ভিডিও আপলোড করেছে, ওর কয়েকজন বন্ধু মিলে ওর পায়ে আলতা দিচ্ছে। ও লিখেছে ‘আলতা আলী হয়ে গেলাম’।

আমি তখনও ভাবিনি একটু পরেই আমাকে আরও একটা ধাক্কা সামলাতে হবে। স্ক্রল করে নিচে গিয়ে দেখলাম তার একটা ছবি। উঠে বসেছে। লুঙ্গি পড়নে। এক পা দেখা যাচ্ছে। আরেক পা ভাজ করার মত লাগছে। খটকা লাগলো। জুম করে দেখি লুঙ্গির ভেতরে তার পা নেই৷ কেটে বাদ দিতে হয়েছে। কয়েক মুহুর্ত কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল।

সেই ছবিটায় সে লিখেছে– ‘প্রেয়সী; স্ট্রেচারের হ্যান্ডেলগুলো ধরলে, তোমার হাত ধরার জন্য আর কোনো হাত থাকে না। তাই বিদায়।’

আরেকটা ছবিতে লিখেছে
‘নীল শাড়ীতে আগুন দিয়ে আনলি কিনে ঝড়,
কোন দুঃখেরে করলি আউশ,
এ যে, লেঙরা বেটার ঘর।’

ভাবছি তার সাথে দুদণ্ড কথা বলব। কিন্তু কি বলব? ওর দুঃখে কাতর আমি ‘পাথর ওকে’ কোন স্বান্ত্বনার বাণী শুনাবো? স্রষ্টা সব কিছুই ভালোর জন্য করে। কিন্তু এই ভালোতো কেউ চায়না।

লেখক- সহ-সম্পাদক (বার্তাবাজার)

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর