পাহাড়ের রাণী দার্জিলিংয়ের পথে

আকাশের শুভ্র মেঘের আস্তরণ ভেদ করে পাহাড়ের পর পাহাড় সারিবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মনোরম শহর দার্জিলিং। পাহাড়ের রাণী নামে খ্যাত দার্জিলিং পৃথিবীর সুন্দরতম জায়গা গুলোর একটি। গরমের উষ্ণতা আবার হিম শীতল ঠান্ডার অনুভূতি দুটোই উপভোগ করা যায় এই পাহাড়ের দেশে।

দার্জিলিং এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় (বাকৃবি) সাংবাদিক সমিতির বাৎসরিক ট্যুরে এগার জনের একটি দল ঘুরতে যায়। আমিও বাকৃবি সাংবাদিক সমিতির একজন সদস্য হিসেবে দার্জিলিং এর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য তাদের সাথে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করা আমার নেশার মত। প্রকৃতির খুব কাছে গিয়ে, তার ইতিহাস সম্পর্কে জেনে, পরখ করে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে মনের প্রশান্তির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দিতে কার না ভালো লাগে!

২১ মার্চ ২০১৯ রাত ৯টায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় থেকে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হই। সকালে পৌঁছাই বুড়িমাড়ি বর্ডারে এবং পরে ইমিগ্রেশন শেষ করে প্রথম বারের মত ইন্ডিয়ার মাটিতে পদার্পণ করি। ইন্ডিয়ার চেঙ্গারবান্দা বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি হয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছাই পাহাড়ের রাণী দার্জিলিংয়ে।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে ভূপৃষ্ট থেকে যখন জীপে করে পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথ ঘেষেঁ মেঘের আবরণ ভেদ করে উপরের দিকে উঠছিলাম অনুভূতিটা ছিলো এক কথায় অসাধারণ। সমতল থেকে ৭১০০ ফুট উচ্চতায় উঠার সময় তাপমাত্রার পরিবর্তনটাও ছিলো লক্ষণীয়। দার্জিলিং এ হিমালয়ের নাতিশীতোষ্ণ আবহওয়া বিরাজ করে। তাই সমতলের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে নেমে পাহাড়ের চূঁড়ায় গিয়ে দাঁড়ায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

পাহাড় বেঁয়ে উপরে উঠার সময় গাড়ীর স্বচ্ছ জানালা দিয়ে দেখছিলাম কত সুন্দর করে সাজানো গোছানো ঘর-বাড়ি। মানুষজন যার যার কাজ করছে নির্বিঘ্নে, ধুলোবালি হীন পরিষ্কার শহর। আর রাস্তর দু’পাশে পাহাড় কেটে এত সুন্দর করে জনবসতি গড়ে উঠেছে যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ^াস করা যাবে না। একটি উন্নত শহরের যত গুলি বৈশিষ্ট্য থাকে প্রতিটির যেন প্রতিফলন দেখতে পারছিলাম চোখের সামনে। এর আগে দার্জিলিংয়ের ইতিহাস ঘেটে দেখেছিলাম গ্রীষ্মকালে সমতলভূমির প্রচ- দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা দার্জিলিংয়ের মনোরম আবহাওয়ায় বসবাস শুরু করলে দার্জিলিং একটি শৈলশহর ও স্বাস্থ্য উদ্ধারকেন্দ্র হিসেবে গড়েওঠে। আর্থার ক্যাম্পবেল ও রবার্ট নেপিয়ার এই শৈলশহর গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টার ফলে ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাহাড়ের ঢালে চাষাবাদ ও ব্যবসা বাণিজ্য শুরু হলে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা শতগুণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমতলের সঙ্গে সংযোগকারী প্রথম সড়কপথ নির্মিত হয়। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য অস্ত্রাগার নির্মিত হয় এবং ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে এই শহরকে পুরসভায় পরিণত করা হয়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাণিজ্যিক ভাবে চা চাষ শুরু হলে বেশ কিছু ব্রিটিশ চা প্রস্তুতকারক এই স্থানে বসবাস শুরু করেন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং শহরকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী রূপে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষনা করা হয়। স্কটিশ ধর্মপ্রচারকরা ব্রিটিশ আধিবাসীদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা শুরু করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং হিমালয়ান রেল চালু হলে শহরের উন্নয়ন আরো দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

একদিকে মনোরম পাহাড় এবং অন্য দিকে বড় বড় দালান ও ব্রিটিশদের পাহাড় কেটে করে যাওয়া রেল লাইন দেখতে দেখতে পৌছালাম আমদের কাঙ্খিত হোটেলে। সারাদিন জার্নি করার পর বিশ্রাম করে নিলাম। কারণ সকালে আমরা সবাই দার্জিলিং এর বিভিন্ন ষ্পট দেখতে বের হবো।

ভোর ৩ টা বেজে ৩০ মিনিট মোবাইলের এলার্ময়ের শব্দে ঘুম ভাঙল। রাতে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম কারণ ভোরে দেখতে হবে টাইগার হিলের চূড়াঁ থেকে চিত্তাকর্ষক সূর্যোদয়। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রওনা দিলাম টাইগার হিলের উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখি প্রায় ৩ হাজরেরও বেশি মানুষ সকালের শান্তির ঘুম বিসর্জন দিয়ে ভিড় জমিয়েছে প্রকৃতির মায়াবী রূপ দেখার জন্য। ঠেলাঠেলি করে আমিও দাড়াঁলাম এক পাহাড়ের চূড়াঁয়। কিছুক্ষন পরে দেখি দূরে এক পাহাড়ের চূড়ায় লাল টকটকে রক্তিম সূর্য আস্তে আস্তে মাথা তুলে উপরের দিকে উঠছে আর অন্ধকারকে করছে দূরীভূত। মনোমুগ্ধকর সেই দৃশ্য দেখে বুঝতে পেরেছি কেন এত মানুষ ভিড় করে টাইগার হিলে।

চমৎকার সূর্যোদয় দেখার পরে আবার রওনা দিলাম পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিকাল পার্কের উদ্দেশ্যে। এই চিড়িয়াখানায় রেড পান্ডা, স্নো লেপার্ড, তিব্বতীয় নেকড়ে সহ পূর্ব হিমালয়ের প্রচুর বিপদগ্রস্ত ও বিলুপ্তপ্রায় পক্ষী ও প্রাণীদের দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এত ঠান্ডা পাহাড়েও বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিলল জুলুজিকাল পার্কে।

টেলিস্কোপে দেখেছিলাম দার্জিলিংয়ের আরও কিছু জায়গা যেমন- ধীরধাম মন্দির, এটি কাঠমান্ডুর বিখ্যাত পশুপতিনাথ মন্দিরের অনুরূপ করে বানানো হয়েছে। বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম এই জাদুঘর গাছপালা ও পশুপাখিদের প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্দরে প্রবেশ করায়। লাওডস্ বোটানিক্যাল গার্ডেন এই উদ্যানে অর্কিড, রডোডেনড্রন, ম্যাগনোলিয়া, প্রিমুলা, ফার্ন সহ নানা জাতের হিমালয়ান উদ্ভিদ পাওয়া যায় এখানে। লেবং রেস কোর্স, এটি পৃথিবীর সবচেযয়ে ছোট এবং সর্বোচ্চ রেস কোর্স। ঘুম বৌদ্ধ মনেস্ট্রি এই অ লের সর্ববৃহৎ মনেস্ট্রি। অবজারবেটরি হিল, ধীরধাম মন্দির এবং বৌদ্ধ সংরক্ষণালয় এই পর্যবক্ষেণ পাহাড়ের উপর অবস্থিত।

দার্জিলিং বিখ্যাত এবং এর নামকরণ করা হয়েছে যার জন্য তা না দেখলে কি হয়? বিশে^র মধ্যে চা উৎপাদনের জন্য দার্জিলিং অনেক খ্যাতি অর্জন করেছে। চা বাগান দেখার জন্য দার্জিলিং এর সবচেয়ে সুন্দর এবং বড় চা বাগানে গেলাম। পাহাড়ের উপর চা গাছের আবরণ পাহড়ের সৌন্দর্যকে আরও কযেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। পাহড়ের চূড়া আর মেঘের মাঝে কুয়াশা খেলা করছে আর চা বাগান থেকে চা তুলছে দার্জিলিং এর চা উৎপাদনকারীরা। সেখানে একটি দোকানে দার্জিলিং এর চা টেষ্ট করলাম। এখানে তিন প্রকারের চা পাওয়া যায় ব্ল্যাক, গ্রীন এবং মিল্ক টি নামে বিক্রি করে স্থানীয়রা।

চা বাগান দেখতে দেখতে সূর্য অস্ত গেল। আমরাও চলে এলাম হোটেলে। রাতের খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিট দার্জিলিং থেকে মিরিখ হয়ে আবার শিলিগুড়ি যাব। গাড়ি আসল যথা সময়ে, রওনা দিলাম মিরিখের উদ্দেশ্যে। আবার পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম সমতল থেকে প্রায় ৮০০০ মিটার উচ্চতায়। মনে হচ্ছিল যেন মেঘেদের রাজ্যে চলে এসেছি। রাস্তার দু’ধারে বড় বড় পাইন গাছ এবং ঝাও গাছের বন। এত ঘন গাছের সাড়ি দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো ভৌতিক জায়গায় চলে এসেছি। খুব সুন্দর ছিলো জায়গাটি। এরপর পাহাড় থেকে নামতে শুরু করলাম ঠান্ডার শহর ছেড়ে দিয়ে আবার উষ্ণতার আভা যেন গাযে এসে লাগছিলো। দুপুরের দিকে পৌঁছালাম মিরিখে। বিশাল বড় লেক, লেকের ওপারে গড়ে উঠেছে আরও একটি সুন্দর শহর।

মিরিখ দেখা শেষ করে আমরা সবাই শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শিলিগুড়ি এসে কলকাতা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কলকাতা ঘুরার অনুভূতি অন্যদিন বলব। সব মিলিয়ে দার্জিলিং ট্যুরটা ছিলো সত্যি অসাধারণ এবং সারাজীবন মনে রাখার মত একটি অভিযান।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর