দীপনা চাকমা: সংগ্রামী এক নারীর গল্প

দীপনা চাকমা দীপু’র সাথে ফেসবুকে প্রথম পরিচয় মূলত পাহাড়ের একজন প্রতিবাদি নারী হিসেবে আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে। দ্বিতীয় পরিচয় একজন কবি হিসেবে। আর এখন তৃতীয় পরিচয় একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে।

দুই সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে দীপনার সংসার। একটা সময় মোটামুটি ভালোই চলছিল তাদের। তখন গ্রামের বাড়িতে ছিল বলে অভাবটা ততটা ছিল না, তাছাড়া মোটামুটি আয় রোজগারও খারাপ হচ্ছিল না। কিন্তু বিপদে পড়ে যায় গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে। শহরে আসার মূল কারণ ছেলেকে ভালো করে পড়াশোনা করানো। প্রথম প্রথম ভালোই যাচ্ছিলো দিন। আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ে তার স্বামী। আয় রোজগার একরকম বন্ধ হয়ে যায়। বড় ছেলের পড়াশোনা, ছোট মেয়েটার খরচের পাশাপাশি সংসারের খরচ সংস্থান করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছিল দীপনাকে।

ছবি: বার্তা বাজার

দীর্ঘদিন ধরে স্বামী অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন বলে সংসারটাকে এখন একলা টেনে নিচ্ছে সে। মাঝে মধ্যে এটা সেটা করেও কোন কূলকিনারা করতে পারছিলনা সে। হঠাৎ করেই মাথায় বুদ্ধি এলো ঘরে নানান ধরনের খাবার তৈরি করে বাজারে বিক্রি করবে সে। যেই ভাবা সেই কাজ। সামান্য কিছু পুঁজির ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে তৈরি করতে শুরু করলো নানান স্বাদের খাবার। তৈরি করতে শুরু করলো মজাদার সিঙ্গারা, সমুচা, রোল, পরাটা, কাবাবসহ পাহাড়ের নানান ধরনের মুখরোচক খাবার। সংসারের নানান সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বেশির ভাগ মানুষই যখন দিশেহারা হয়ে পথ হারাতে বসে তখন তাদের জন্য একটা উদাহরণ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছে দীপনা। হার মানেনি জীবনের কাছে, বরং নতুন করে স্বপ্ন সাজিয়েছে ছোট পরিসরে।

সমস্যার এখনো শেষ হয়নি। নিজের কোন দোকান নেই। তাই এতদিন এলাকায় অন্যের দোকানে নিজের হাতে তৈরি মজাদার সব খাবার তৈরি করে বিক্রি করতে হতো। সেখানেও ছিল নানান প্রতিবন্ধকতা। কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে সেই দোকানীকে নিষেধ করে দেয় যাতে তার কোন সামগ্রী তারা নিজেদের দোকানে বিক্রি না করে! হতাশ হয়নি দীপনা একবিন্দুও। সিদ্ধান্ত নিলো বরং এখন থেকে এলাকায় রাস্তার পাশে কোন গাছের কিংবা কোন ল্যাম্পপোস্টের তলায় সে সাজিয়ে নিবে রোজ নিজের অস্থায়ী দোকান। সেই ভাবনা থেকেই নিজের বাসস্থানের কাছেই খাগড়াছড়ি পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের উপালি পাড়ায় বিহার সংলগ্ন কালভার্টের পাশে, পাড়ার মূল রাস্তার মোড়ে এবার থেকে পাওয়া যাবে দীপনা’র নিজের তৈরি মুখরোচক নানান খাবার। প্রতিদিন হয়তো একই আইটেম থাকবে না, একেকদিন একেক ধরনের মজাদার খাবার নিয়ে হাজির থাকবে সে। বেচাবিক্রি যেটুকু হচ্ছে তাতেই সন্তুষ্ট সে। লোকজন জানতে পারলে হয়তো বিক্রির পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়বে। স্বপ্ন তার, একদিন ছোট পরিসরে হলেও নিজের একটা দোকান হবে। পিছনে তাকাতে বা কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না কখনো।

ছবি: বার্তা বাজার

দীপনা’র কথা, “যতই কষ্ট হোক, যতই মাথার ঘাম পায়ে পড়ুক তবুও নিজের হাতে উপার্জিত টাকায় খেতে তৃপ্তি লাগে, আনন্দ লাগে। যা কেউ ভালবেসে, সহানুভূতিশীল হয়ে কিছু দিলে তা নিতে যেমন খারাপ লাগে তেমনি সেই টাকায় কিছু খেলে গলায় আটকে থাকার মত অস্বস্তি হয়। নিজেকে অনেক অনেক ছোট মনে হয়। আত্মসম্মানে ভীষণ লাগে।

প্রায় আট বছর হতে চলল আমার কোন আয়ের পথ নেই। ছেলেকে জেলা শহরে পড়াতে এসে সমস্ত আয়ের পথ নিজ হাতে বন্ধ করে চলে এসেছিলাম। সেই সময়ে আমার হাতে একদম টাকা নেই বললেও পাঁচ ছয় হাজার নগদ থাকতো। জেলা শহরে এসে নেই মানে হাত একদম খালি থাকে। তবুও মনোবল হারাইনি। মেয়েটা বড় হয়ে উঠলে কোন না কোন একটা আয়ের উৎস তৈরি করবো সেটা আমার প্রতিজ্ঞা ছিল। একটাই কামনা করেছিলাম যেন সুস্থ থাকি। সুস্থ থাকলে যত কষ্টই হোক সৎভাবে যে কোন কাজে নিজেকে প্রস্তুত করবো।

সময় সবসময় এক থাকে না। আট বছর আগে আমার সুদিন ছিল। স্বামীর কাছ থেকে কোন পয়সা না নিয়ে আমার নিজের উপার্জিত টাকায় আমি নিজের প্রয়োজন ছাড়া সংসারেও ব্যয় করতাম। আমি জানি দেরিতে হলেও সেই বিগত সুদিনগুলো আমার কাছে আবার ফিরে আসবেই। আমার স্বামী দ্রুত আরোগ্য লাভ করুক এটুকুই বর্তমান চাওয়া আমার।”

সংগ্রামী এই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাটা আজ থেকে আরো বেশি বাড়লো। হার না মানা এই জীবন সংগ্রামে সফল হবে দীপনা- এটাই প্রার্থনা করছি।

বার্তা বাজার/টি.সি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর