‘এখনই বাংলাদেশে ১০% মানুষের টেস্ট করালে ত্রিশ লাখের করোনা শনাক্ত হবে’

বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি। শুধু ঢাকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখের বেশি থাকতে পারে বলে দাবি করেছে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। ঢাকার জনসংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। তাহলে ঢাকার ৩.৭৫% মানুষ আজ করোনা আক্রান্ত।
কিন্তু আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে সে অনুযায়ী এখন টেস্ট ও আক্রান্তের গড় ২০%। তাহলে চিত্রটা ভয়াবহ হবার সম্ভাবনাই বেশী। আর এখন সবাই ঢাকা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। তাহলে পুরো দেশের চিত্র কেমন হতে পারে?

আচ্ছা দেখা যাক বাস্তব অবস্থাটা কি হতে পারে? গত এক মাসের তথ্য যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই-

৬ই মে ২০২০ তারিখে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী ছিল ১১,৭১৯ জন।

৫ই জুন ২০২০ তারিখে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০,৩৯১ জনে।
তাহলে গত এক মাসে করোনা আক্রান্ত রোগী বেড়েছে ৪৮,৬৭২ জন। গড়ে প্রতিদিন ১,৬২২ জন!

যেখানে এক মাস আগে সর্বমোট টেস্ট এর সংখ্যা ছিল ৯৯,৬৪৬ টি। গতকাল পর্যন্ত টেস্ট হয়েছে ৩,৮৪,৮৬৩ টি।
তাহলে এক মাসে সর্বমোট টেস্ট হয়েছে ২,৮৫,২১৭ টি। গড়ে ৯,৫০৭ টি টেস্ট।
প্রতিদিন গড়ে ৯৫০৭ টেস্ট এর বিপরীতে আক্রান্তের সংখ্যা ১,৬২২ জন। যা গড়ে ১৭% এর মত।

এখন এক দিনের চিত্র যদি দেখি-

গতকাল (৫ই জুন ২০২০) টেস্ট হয়েছে ১৪,০৮৮ টি ও করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৮২৮ জন। যা গড়ে ২০% এর মত।
এক মাস আগে (৬ই মে ২০২০) টেস্ট হয়েছিল ৬,২৪১ টি আক্রান্ত হয়েছিল ৭৯০ জন। গড়ে ৭.৯%।

তাহলে এক মাসে টেস্ট এর বিপরীতে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৯% থেকে ২০% এ।

তাহলে যদি আমরা এক দিনে ১,০০,০০০ টেস্ট করতে পারতাম, কমপক্ষে ২০,০০০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা যেত। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব না। আমাদের টেস্ট এর ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু করোনা রোগ তো আর বসে নেই। করোনা তার মত করে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

অন্য একটি তথ্য নিয়ে কথা বলি।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫০ লাখ এর বেশি। তাহলে আমরা যদি দিনে ২০,০০০ করেও টেস্ট করি, দেড় কোটি টেস্ট করতে সময় লাগবে ৭৫০ দিন বা ২ বছর এর মত। (সম্পূর্ণ জনসংখ্যার ১০%)।
ততোদিন কি করোনা বসে থাকবে? প্রতিদিন ২০% হারে যদি করোনা শনাক্ত হয়, আজকেই যদি ১০% জনগণের করোনা টেস্ট করা যায় তাহলে চিত্র হবে এমন- ৩,০০০,০০০ বা ত্রিশ লাখের মত মানুষ করোনায় শনাক্ত হবে। আমরা সবাই জানি এই তথ্য, কিন্তু মানতে চাই না। ভয়ানক চিত্র তাই না?

আর আমরা শুধু ১০% জনগণ নিয়ে হিসাব করেছি। যা দেড় কোটির মত। অন্যান্য দেশে লক ডাউন ফর্মুলা মেনে চলার পরেও চিত্র ভয়াবহ। আর আমরা লক ডাউন না মেনেই কিভাবে আশা করি, আমাদের আক্রান্তের হার কমে যাবে। প্রতিদিন বাসে, রেস্টুরেন্টে, হাট বাজারে, বিভিন্ন মানুষের সমাগম, আসলে আমাদের ভয়াবহ চিত্রই স্মরণ করে দেয়।

সবাই সকল ধরনের চিকিৎসা শেয়ার করেন। বিভিন্ন মেডিসিন কোম্পানি মেডিসিনের ট্রায়াল আসার সাথে সাথেই বাণিজ্যিক আকারে নামানোর প্রস্তুতি নিয়ে নেন। মেডিসিন বাজারজাত করার জন্য মাঠে নেমে পরেন। কিন্তু আমাদের যা সর্বপ্রথম দরকার, তা হল টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট এবং এরপর ট্রেস করা অর্থাৎ রোগ ও রোগীর সম্পর্কে পুরো হিস্ট্রি বা আক্রান্তের তথ্য নেয়া। যা প্রকৃতপক্ষেই আমাদের করোনার বিস্তার লাভ থেকে বাঁচাতে পারে। এভাবে বিশ্বের কিছু কিছু দেশ ইতিমধ্যে সাফল্যের মুখ দেখেছে।

আমরা এও জানি আক্রান্তের ৮০% মানুষ এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে (যা ১০%, দেড় কোটির ) ২৪,০০,০০০ বা চব্বিশ লাখ এর মত। বাকী ৬ লাখ মানুষ (২০%) এর মাঝে, ২৫% বা এক-চতুর্থাংশ মানুষদেরও যদি ক্রিটিকাল বা হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাদের চিকিৎসা দেবার সামর্থ্য আমাদের দেশের কি আছে? যা ১,৫০,০০০ বা দেড় লাখের মত।

এতক্ষণ আমরা যে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করেছি তা শুধু বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ১০% নিয়ে। আমি বাকি ৯০% এর হিসেব পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম।

অনেকেই সব খুলে দিয়ে হার্ড ইমিউনিটির কথা বলছেন। তবে মনে রাখতে হবে হার্ড ইমিউনিটির মত ভয়ঙ্কর পদক্ষেপে যেতে হলে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০-৮০% এর আক্রান্ত হতে হবে। যা অনেক ভয়ানক। হার্ড ইমিউনিটি এ পর্যন্ত শুধু ভ্যাকসিন বা টিকা পেয়ে এবং দিয়েই করা হয়েছে। কখনোই আক্রান্তের হার দিয়ে করা হয়নি। যত ধরণের সংক্রমিত রোগ ছিল তা টিকা বা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। ৯০% জনগণকে ভ্যাক্সিনের আওতায় আনার পরে হার্ড ইমিউনিটি পাওয়ায় সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আক্রান্তদের মাধ্যমে ব্যাপারটা এখনো হাইপোথিসিস। যা আসলেই সম্ভব কিনা কখনোই প্রমাণিত হয়নি। বিভিন্ন দেশ এই হার্ড ইমিউনিটির ধারণা বাতিল করে দিয়েছে। একমাত্র আমেরিকার নিউ ইয়র্কেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা, তবুও তা সেখানকার জনসংখ্যার ২০% এর মত। যা ৭০-৮০% এর অনেক কম। তাছাড়া ভাইরাস এর মিউটেশন বা পরিবর্তন হয়েই চলেছে। আমাদের মত এত জনবহুল জনসংখ্যার দেশে যদি মিউটেশন এ ভাইরাস পরিবর্তিত হয়ে দুর্বল হয়ে যায় তাহলে আমাদের ভাগ্য ভাল, নইলে বিপদের সম্ভাবনা অনেক।

যারাই সংক্রমণের স্বীকার হচ্ছেন, তাদের যদি ট্রেস করতে পারা যেত, তাহলে সংক্রমণের হার অনেক কমানো সম্ভব হত। অনেকের মনে এই প্রশ্ন আসতেই পারে, এই ভাইরাসটা ছড়াচ্ছে কিভাবে? প্রথমেই বুঝতে হবে এই ভাইরাস এর ইন্টিউবিসন এর সময় ২-১৪ দিন, এর মাঝে উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে। তবে সংক্রমণ বন্ধ থাকবে না। আর ভাইরাসের এক্সপোজার ছাড়া এই ভাইরাস ছড়াতে পারে না। তাহলে সংক্রমিতদের হিস্ট্রি নিলেই তা বের করা সম্ভব।

আমরা অনেক মূল্যবান জীবনের বিনিময়ে এই অবস্থায় পৌঁছেছি। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে করুণ অবস্থা, তা বর্তমান চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। তবে আশার কথা এখনো যদি শক্তভাবে হাল ধরা যায়, আমরা হয়তো, আরও অনেক মূল্যবান জীবন বাঁচাতে পারবো।

লিখেছেন-ডাঃ গোলাম হাসনাইন সোহান, সৌদি আরব।

বার্তাবাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর