নায্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের দায় শুধু সরকারের না, সকলের

বাংলাদেশ প্রায় ৯০% মুসলমানের দেশ । আর ধর্মীয় হিসাবে প্রায় সবাই কোন না কোন ধর্ম চর্চা করি। এই দেশে তো কোন অপকর্মই থাকার কথা না কারন সব ধর্মই অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় তৎপর। তারপরও নানা অপকর্ম চলছে দেশজুড়ে। সরকারের বিভিন্ন অঙ্গকে সর্বদায় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়, হিমশিম খেতে হয় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ধর্মের দোহায় দিয়ে কথা বললেও এই দাওয়া আর খুব বেশি কাজ করছে না। তাই জাগ্রত বিবেক দিয়েই বিবেচনা করার সময় এসেছে। ভালো কিছু যেখানেই থাকুক, সেটাকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করতে পারলেই একটি সুখী সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তোলা যায়।

ইসলাম নিয়েই বলি কারণ এ সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি এই দেশে। অন্য ধর্মেও গরীব অসহায় দুঃস্থদের কল্যাণে কাজে করার কথা বলা আছে। ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ যাকাত যা ফরজ বা অবশ্যপালনীয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক যেমন নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক। নামাজের কথায় বললাম, সবাই অন্তত নামাজটা বুঝে। সামর্থ্যবান সবাই যাকাত সঠিকভাবে বের করে দিলে দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠানোর জন্য নতুন কৌশল খুঁজতে যেতে হয় না, এই যাকাতের মধ্যেই সেই বীজ নিহিত আছে। আমরা সুযোগ পেলেই নানা উদাহরণ দিয়ে বসি, মানি কয়টা, সেটা ভেবে দেখা দরকার। যাকাত ধনীর সম্পদে গরীবের হক, এটা কোন দান নয়। সম্পদ পড়ে থাকবে, কিছুই সাথে করে নিয়ে যেতে পারব না। করোনায় মারা গেলে লাশও কেউ ছুঁয়ে দেখবে না। কোন কিছুরই বড়াই খাটে না এই পৃথিবীতে। সবাই মিলে হাসিখুশিতে যদি দিন কাটে, সেটাই সত্যিকারের সুন্দর কিছু।

মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে তো সে বেশি কিছু চায় না। একটু খাবার, কিছু পোশাক আর মাথা গুজার একটি ঠাঁই। দেশের সরকারি হিসেবের গরীব ২০.৫% বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৪১% যদি ভালো থাকে তাহলে মনে হবে দেশটা একটি ফুলের বাগান হয়ে গেছে। নানা রঙের ফুল ফুটে আছে সেখানে, বাতাসে দুলছে আর সবাই হেসে হেসে কথা বলছে। দেশের ব্যক্তিগত পর্যায়ের যাকাতকে প্রতিবছর যদি এই প্রান্তজনদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া যায় তাহলে সরকারের বোঝা অনেকটা লাঘব হবে আর সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো দিকে বেশি নজর দিতে পারবে।

রূপার হিসাবে নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলো বার্ষিক প্রায় ৩৩ হাজার টাকার (৫২.৫ ভরি*৬২২ টাকা) পরিমাণ। কোন ব্যক্তির কাছে বছর শেষে যদি এই পরিমাণ অর্থ জমা থাকে এবং বিনিয়োগে থাকা অর্থ, কারো কাছে ধারে থাকা অর্থ বা এমন সম্পদ যেগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে কেনা হয়েছে এসবগুলোর মূল্য যোগ করে যদি ৩৩ হাজার টাকা বা এর বেশি হয় তাহলে মোট সম্পদের উপর ২.৫% হারে যাকাত বের করতে হয়। মোদ্দা কথা হলো, বছর শেষে নিজ ব্যবহারের সম্পদ বাদে যে সম্পদ হাতে থাকে বা যা সহজেই তরল আকারে রূপান্তর করা যায় তার সবটার মূল্যের উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হয় (ধর্মীয় পণ্ডিতগণের বক্তব্য বিবেচ্য)। অবশ্য ঋণ করে থাকলে বার্ষিক ঋণের কিস্তি বা বার্ষিক মোট ঋণের পরিমাণ বাদ দিয়ে মোট সম্পদ হিসেব করতে হবে।

আমাদের দেশে যেখানে ৪ জনের পরিবারে একজন মানুষই আয় করে সাধারণত। যাকাতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন ধরতে পারল কি পারল না সেটার হিসেব করার সুযোগ নেই। এর দায়বদ্ধতা সরাসরি আল্লাহর কাছে যার কাছে একটু পরেই ফিরে যেতে হবে। দেশে ১৬.৮৬ কোটি মানুষ। ৪ জন করে একটি পরিবার ধরলে ৪.২২ কোটি পরিবার হয়। ৫০% পরিবারকে যদি যাকাতের আওতার বাইরে রাখি তাহলেও ২.১১ কোটি পরিবার যাকাতের আওতায় চলে আসে। পরিবার বলছি এই কারনে যে, আমাদের দেশে পরিবারের কর্তাই সাধারণত সম্পদের মালিক হয়। ২০১৬ সালের একটি হিসেবে দেশে বার্ষিক যাকাতের পরিমাণ হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এভাবে প্রতি বছর যাকাত বের করে যাদের উপর যাকাত ফরজ হয়নি অর্থাৎ দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে বণ্টন করে দিতে হয়।

এই যে করোনাকালীন সঙ্কটে সরকার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে দরিদ্র শ্রেণিকে সহায়তা দিতে, সরকারের সাথে সামর্থ্যবান মানুষগুলো সবাই এগিয়ে এলে কত সহজ ও সুন্দর সমাধান বের করা যায়। দেশের ৪১% দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রতি মাসে পরিবার প্রতি ৪০০০ করে টাকা দিলে খরচ হয় ৬৭৬০ কোটি টাকা। যাকাত হতে পারে এই অর্থের একটি অন্যতম যোগান। একটি সুন্দর রাষ্ট্র গঠনের দায় সকলের। করের পাশাপাশি আল্লাহর পথে নির্ধারিত যাকাত বের করে দিলে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়বে, আর মন্দার প্রভাব অনেকাংশেই কমে আসবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই মন্দা দূর হয়ে যাবে, পাশাপাশি রাষ্ট্রতো আছেই। একটি কল্যাণমূলক, নায্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন হয়ে যাবে খুব সহজ একটি ব্যাপার।

লেখক: মো: শাহাদত হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
লালমনিরহাট সরকারি কলেজ।

বার্তা বাজার/এম.সি

* প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বার্তা বাজার-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বার্তা বাজার কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর