ট্যাক্সি চালক থেকে যেভাবে উপজেলা আ.লীগ সভাপতি রুহুল আমিন

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর আলোচনায় আসেন।

জানা গেছে, রুহুল আমিন পেশায় একজন ট্যাক্সিচালক ছিলেন। দেশে-বিদেশে ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। আগে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করতেন। সোনাগাজী উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্য ছিলেন। সেখান থেকে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এরপরই ধীরে ধীরে দলটির উপজেলার শীর্ষ পদ দখল করেন।

হত্যাকারীরা নুসরাতের গায়ে আগুন লাগানোর পর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিনকে ফোনে ‘কাজ হয়ে যাওয়ার’ ম্যাসেজ জানায়। এ সময় রুহুল বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা পালিয়ে যাও। আমি থানায় যাচ্ছি। রহুল আমিনের এমন নির্দেশের পর ঘটনাস্থল থেকে তাদের সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলযোগে সরিয়ে নেওয়া হয়।

পিআইবি’র হাতে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনের এমন নির্দেশের ৬ সেকেন্ডের একটি অডিও বার্তা রয়েছে।

সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উচিয়াঘোনা কেরানি বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন। পড়াশোনা করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত।

পিবিআিই জানায়, নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা চালানো হয়। এটি সমন্বয় করেন থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ও রুহুল আমিন। সহযোগিতা করেন আওয়ামী লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর মকসুদ আলম। আর টাকার যোগান দেন অধ্যক্ষের স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার। তাদেরই একটি সিন্ডিকেট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা এবং নিজেদের আইডি থেকে অপপ্রচার চালানোর দায়িত্ব পায়।

পিবিআই সূত্র আরও জানায়, অর্থের যোগানের জন্য ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ৫ এপ্রিল মাদ্রাসার ভেতরের পুকুর থেকে মাছ ধরে বাজারে সোয়া এক লাখ টাকা বিক্রি করেন রুহুল আমিন ও মাকসুদ আলম।

উপজেলা আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, সোনাগাজী উপজেলার বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতা ও সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিন এক সময় জাতীয় পার্টির সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে সোনাগাজী ফরিদ সুপারমার্কেটের সামনের এক সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফয়েজুল কবিরের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সৈয়দ দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ১৯৯৭ সালে অওয়ামী লীগে যোগদানের পর চার বছর দলীয় কোনো কার্যক্রমে অংশ নেয়নি রুহুল আমিন। ২০০১ সালে চলে যান সৌদি আরব। সেখানে ট্যাক্সি চালাতেন। ২০০৯ সালে সোনাগাজী ফিরে আসেন। ২০১৩ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে ৪৪ নম্বর কাউন্সিলর মনোনীত হন। ২০১৫ সালে রুহুল আমিন অনেকটা আকস্মিকভাবে সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাইস্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন।

সৈয়দ দ্বীন মোহাম্মদ অভিযোগ করেন, রুহুল আমিন ও তার লোকজন জোর করে ওই পদটি দখল করে নেয়।

২০১৫ সালে জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার টেন্ডারবাজি ও অনিয়ম দুর্নীতির বিরোধিতা করায় হঠাৎ রহিম উল্লাহকে বাদ দিয়ে ১ নম্বর সহসভাপতি করা হয় রুহুল আমিনকে। এরপর ২০১৭ সালে ফয়জুল কবীর চিকিৎসাধীন থাকার সুযোগে প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন রুহুল আমিন।

সৈয়দ দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘২০১৮ সালের শুরুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় রুহুল আমিনকে প্রথমে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো কাউন্সিল ও দলীয় রেজুলেশন ছাড়াই নিজেকে সভাপতি ঘোষণা দেন রুহুল আমিন। আর এসবের নেপথ্যে ছিল জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফয়জুল কবির বলেন, ‘আমি পদ থেকে পদত্যাগও করিনি, আবার আমাকে বাদও দেওয়া হয়নি। আমি অসুস্থতার কারণে দলীয় কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছি না। তাহলে অন্য কেউ কিভাবে এ পদে এলেন, তা বোধগম্য নয়।’

ফয়জুল কবির বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য হাজী রহিম উল্যাহর লোকজন নিয়ন্ত্রিত ছোট ফেনী নদীর মুহুরী প্রকল্প অংশের বালুমহাল ও ছোট ফেনী নদীর সাহেবের ঘাট এলাকায় বড় বালুমহাল উপজেলা সভাপতি হওয়ার পর রুহুল আমিন ও তার লোকজন দখলে নেন। এখনো এ দুটি বালুমহালে কয়েক কোটি টাকার বালু রয়েছে।

সোনাগাজী ইসলামীয়া সিনিয়র মাদ্রাসার একাধিক সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সোনাগাজী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মামুন ওই মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু ছয় মাস আগে নানা কৌশলে শেখ মামুনকে বাদ দিয়ে রুহুল আমিন সদস্য মনোনীত হন। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সহসভাপতি বনে যান। নানা অপকর্ম ঢাকতে এবং নিজের প্রভাববলয় বাড়াতে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলা নিজে রুহুলকে সদস্য হওয়ার সুযোগ করে দেন।

অভিযোগ রয়েছে, মাদ্রাসার মার্কেটের ১২টি দোকান, ভেতরের বিশাল পুকুরের মাছ চাষ ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা উপায়ে আদায় করা বাড়তি টাকারও ভাগ পেতেন সহসভাপতি রুহুল আমিন ও আরেক সদস্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম। এই ক্যাম্পাসের বাইরেও মাদ্রাসার রয়েছে জমিসহ কোটি টাকার সম্পদ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদ্রাসার একজন শিক্ষক জানান, সিরাজ তাদের প্রায়ই বলতেন, ‘শোনো, রুহুল-মাকসুদ এরা সবাই অশিক্ষিত। এরা থাকলে দুই রকম সুবিধা, একদিকে এরা কোনো বিষয়ে উচ্চবাচ্য করবে না। আবার সব সময় আমাদের পক্ষেও থাকবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য আবুল কালাম বাহারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে রুহুল আমিন ও তার ক্যাডাররা। সোনাগাজী সদর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা স্বপন, চরদরবেশ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ, মতিগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটনসহ অনেকেই বিভিন্ন সময় হামলা-মারধরের শিকার হয়। অনুগত না হওয়ায় বাদ দেওয়া হয় পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবসার ও উপজেলা আওয়ামী লীগের উপ-তথ্যসম্পাদক আবদুর রহিম খোকনকে।

মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টায় উপজেলার তাকিয়া বাজার থেকে রুহল আমিনকে আটক করা হয়।

পিবিআই জানায়, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীমের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে ১৩ থেকে ১৪ জনের নামে উঠে আসলেও নামে-বেনামে প্রায় ২৫ থেকে ২৬ জন জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিনের সম্পৃক্ততার কথা এখন অনেকটা নিশ্চিত।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর