ছয় ধরনের ভোটারের হাতে জয়-পরাজয়

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত ৬ ধরনের ভোটার ফল নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখবেন বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বস্তিবাসী, সনাতন ধর্মাবলম্বী ও আঞ্চলিক ভোট যারা টানতে পারবেন, তারাই জয়ের মুখ দেখবেন।

এর বাইরে তরুণ ভোটাররা কোন দিকে ঝুঁকবেন, সেটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মোট ভোটারের অর্ধেকের বেশি তরুণ, যারা অনেকটাই নির্বাচনবিমুখ। নারী ভোটারদের অধিকাংশ সব সময় একদিকে যায়। শ্রমিকরা বরাবরই অধিকারবঞ্চিত। তাই তাদের ভোটও বরাবর একটি পক্ষের দিকেই ঝোঁকে।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি দুই সিটিতে ভোটগ্রহণ হবে। সেদিন শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কর্মজীবীদের অনেকেই গ্রামের বাড়ি যান। তাই ভোটারদের একটি অংশ বাড়ি গেলে ভোটার উপস্থিতিতে কিছুটা ভাটা পড়বে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করাই বড় চ্যালেঞ্জ। আগের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা থেকেই এটি নিয়ে ভাবতে হবে। তরুণদের মধ্যে ভোটদানের আগ্রহ কম। রাজনীতি নিয়ে অনীহা বেশি। প্রার্থীদের প্রচারে তারা কতটুকু আগ্রহী হয়েছেন তা দেখতে হবে। নইলে তাদের কেন্দ্রমুখী করা দুরূহ হবে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দুই সিটি নির্বাচনে ৫০ লাখের বেশি ভোটার রয়েছেন। পাঁচ বছর আগের নির্বাচনে ভোটার ছিল ৪০ লাখ। এবারে নির্বাচনে দুই সিটির পরিধি বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৫৯২ ভোটার, যারা প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তারাও নগরপিতা বাছাইয়ে ফ্যাক্টর হতে পারেন।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আসলে কত সংখ্যক লোক ভোট দিতে যাবেন বা যেতে পারবেনÑ সেটি একটি বিষয়। এর মধ্যে একটি বিষয় হলো নতুন ভোটারদের ভোটদানে আগ্রহ বেশি থাকে। সংখ্যার বিচারে নতুন ভোটারের সংখ্যা বেশি। যারা জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রাখতে পারেন।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনে ওয়ার্ড ছিল ৩৬টি। ভোটার ছিলেন ২৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন। এবার ওয়ার্ড বেড়ে হয়েছে ৫৪টি। ভোটার ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫৩০ জন এবং নারী ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৯১ জন। মেয়র নির্বাচনে নতুন যুক্ত ওয়ার্ডে প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন ৬ লাখ ৯০ হাজার ২৪৭ জন।

দক্ষিণ সিটিতে ২০১৫ সালের নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৩ জন। ওয়ার্ড ছিল ৫৭টি। এবার ওয়ার্ড ৭৫টি, ভোটার ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১২ লাখ ৬৩ হাজার ৫৬৭ জন এবং নারী ভোটার ১১ লাখ ৩ হাজার ৫৩১ জন। প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৫ জন।

এবারের সিটি নির্বাচনে নতুন ভোটার ১২ লাখ হলেও তরুণ ভোটার অর্থাৎ, ৩০ বছরের কম বয়সী ভোটারের সংখ্যা মোট ভোটারের অর্ধেকের বেশি। এই ভোটারদের ভোট প্রদানে অনীহা বেশি। তারা সহজে ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না।

রামপুরা মহানগর প্রজেক্টের বাসিন্দা ইভান শাকিল বলেন, ‘আমি একবারও ভোট দেইনি। দেশের জন্য, এলাকার জন্য কাজ করবেন এমন প্রার্থী পাওয়া মুশকিল। আবার ভোট দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পরিবেশ থাকে না। তাই এবারও ভোট দেওয়ার ইচ্ছা তেমন নেই।

ঢাকা দক্ষিণের পুরান ঢাকায় হিন্দু ভোটার বেশি। শুধু সূত্রাপুর থানায় হিন্দু ভোটার আছেন ৮০ হাজারের বেশি। এর বাইরে রায়েরবাজার, লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারিবাজার, গে-ারিয়া, ফরিদাবাদ, চানখাঁরপুল, অভয়দাস লেন, বংশাল, জজকোর্টের পেছনের এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ৪ লাখের মতো হিন্দু ভোটার আছেন। তাদের কাছে প্রয়াত সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা জনপ্রিয় ছিলেন।

প্রয়াত বাবার প্রতি সহানুভূতি কাজে লাগিয়ে এ ভোট পেতে চাচ্ছেন দক্ষিণে বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। এ সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বাবা শহীদ শেখ মণির সঙ্গে পুরান ঢাকার অনেক স্মৃতি জড়িত।

আওয়ামী লীগের সঙ্গেও হিন্দু ভোটারদের সম্পর্ক বরাবরই ভালো। তাই নৌকার পক্ষের নেতাকর্মীরা মনে করেন, হিন্দু ভোটারদের সমর্থকন তাদের দিকেই থাকবে। উত্তর সিটিতে অবশ্য হিন্দু ভোটার কম।

রামপুরা জেলেপাড়া, মেরুল বাড্ডা, উত্তরখানের ময়নারটেক, মিরপুরের মনিপুরিপাড়া, খিলক্ষেত এলাকায় হিন্দু ভোটার আছেন। সব মিলিয়ে দুই লাখের বেশি হিন্দু ভোটার আছেন এই সিটিতে। এখানেও তাদের ঘিরে দুই প্রার্থী নানা হিসাব কষছেন।

লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা মনীষা সাহাকে ভোটদানের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যোগ্য প্রার্থীই ভোট পাবেন। দক্ষিণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থীই শিক্ষিত। ইশরাক তরুণ ও রাজনীতিতে নবীন হলেও ভোটের মাঠে কেউ কারও চেয়ে কম নয়। মানুষ ভেবে-চিন্তেই ভোট দেবেন।

ঢাকা দক্ষিণে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রভাব বেশি। সাদেক হোসেন খোকা পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। এ পরিচয় কাজে লাগাতে চান ইশরাক হোসেন। উত্তর সিটির তেজগাঁও বেগুনবাড়ী, আরজতপাড়া, নাখালপাড়া, তেজকুনিপাড়া, তেজতুরিবাজার, কারওয়ানবাজার, দক্ষিণখান, উত্তরখান, উত্তরা, খিলক্ষেতসহ কয়েকটি এলাকায় বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ভোটার বেশি।

কুমিল্লার ভোটও কম নয়। ধানের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ফেনীর সন্তান। নৌকার প্রার্থী আতিকুল ইসলামের বাড়ি কুমিল্লায়। আঞ্চলিক ভোটারদের টানতে দুজনের চেষ্টা রয়েছে। নোয়াখালী অঞ্চলের অনেক নেতাই এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন।

উত্তর সিটির বনানীর কড়াইল বস্তিতে ভোটার প্রায় ৩০ হাজার। বেগুনবাড়ী বস্তি, তেজগাঁও বস্তি, মিরপুরের চলন্তিকা বস্তি, মহাখালী সাততলা বস্তি মিলিয়ে কয়েক লাখ ভোটার আছেন। মধুবাগ ও মগবাজারের রেললাইন এলাকাতেও বস্তি রয়েছে।

এই ভোটাররা কোনদিকে ঝুঁকেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দক্ষিণ সিটির কমলাপুর, গোলাপবাগ, মানিকনগর, কামরাঙ্গীরচর, রায়েরবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় বস্তিবাসী ভোটার রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটিতে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে ভোটার প্রায় ৪০ হাজার।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মুজমদার বলেন, তরুণরা ভোট দিতে গেলে জয়-পরাজয়ে প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া দরিদ্র শ্রেণির ভোটারও ফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখেন। তবে ভোটের আগের দিন শুক্রবার হওয়ায় অনেকে বাড়ি যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে দরিদ্র ও কর্মজীবীদের কত লোক ঢাকায় থাকবেন সেটি দেখার বিষয়।

এবারই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীক ও ইভিএমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুই সিটির নির্বাচন। দলীয় প্রতীকে ভোট হওয়ায় প্রচারও জমজমাট। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে ইভিএমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট পড়ার হার খুব কম।

বার্তাবাজার/কেএ

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর