দুই ভাইবোন হয়েছেন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক!

শিক্ষা কার্যক্রমে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য খ্যাতিমান অধ্যাপকদের চাকরির নির্দিষ্ট বয়সসীমা শেষে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। যাঁদের ইমেরিটাস অধ্যাপকের মর্যাদা দেয়া হয় তাঁরা একজন অধ্যাপকের পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। দেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খ্যাতিমান অধ্যাপকদের এ মর্যাদা দেয়ার রীতি আছে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইমেরিটাস অধ্যাপকের সংখ্যা একবারেই কম৷ এই কম সংখ্যার মধ্যেই একই পরিবার দুই ভাইবোন হয়েছেন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক! যারা দু’জনই নিজ নিজ ক্ষেত্রের উজ্জল নক্ষত্র!

এঁদের মধ্যে একজন জামাল নজরুল ইসলাম। যাকে বলা হয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিজ্ঞানী। আরেকজন সুলতানা সারওয়াত আরা জামান।যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী ও লোকহিতৈষী। তিনি মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘বিশেষ শিক্ষা’ আন্দোলনের একজন পথপ্রদর্শকও বটে৷

জামাল নজরুল ইসলাম: বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে মৌলিক বিজ্ঞানে তাঁর মতো অবদান আর কারও নেই। তেমনি বিশ্ব বিজ্ঞানের সারস্বত সমাজে তাঁর মতো সমাদর ও খ্যাতিও কারও ছিল না। এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম ঝিনাইদহে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে।

জামাল নজরুল ইসলামের স্কুলজীবন শুরু হয় কলকাতায়, সেখান থেকে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন, শেষে পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করেন। বিএসসি সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে। এরপর বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ট্রাইপজে তিন বছরের কোর্স দুই বছরে শেষ করেন। ১৯৬০ সালে কেমব্রিজ থেকেই মাস্টার্স। ১৯৬৪ সালে এখান থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ড. ইসলাম অত্যন্ত দুর্লভ ও সম্মানজনক ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ছাত্রজীবনে তাঁর সমসাময়িক ও আজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিস্ময়কর বিজ্ঞান-প্রতিভা স্টিফেন হকিং।

জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছেন। ১৯৭১-৭২ দুই বছর ক্যালটেক বা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৭৩-৭৪ সালে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের শিক্ষক, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মনে সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন।

এর মধ্যে জামাল নজরুল ইসলামের অনেক গবেষণা নিবন্ধ বিখ্যাত সব বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৯৮৩ সালে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বের কসমোলজিস্টদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। দ্রুত বইটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। পরের বছর কেমব্রিজ থেকেই প্রকাশিত হয় ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি। তাঁর গবেষণা আইনস্টাইন-পরবর্তী মহাবিশ্ব গবেষণায় বিরাট অবদান রেখেছে। তিনি এই ধারায় গবেষণা অব্যাহত রেখে পরবর্তীকালে লেখেন ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স বা মহাবিশ্বের দূরবর্তী ভবিষ্যৎ।

সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ কখনো এক সরলরেখায় এলে পৃথিবীর ওপর তার প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। তবে গবেষণায় প্রফেসর ইসলাম আশার কথাই শুনিয়েছিলেন—সে রকম ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কেমব্রিজ এবং পশ্চিমে শিক্ষার গবেষণা ও অধ্যাপনায় থাকাকালে তাঁর বন্ধু ও সুহৃদমহল গড়ে ওঠে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন তাঁর শিক্ষক ফ্রিম্যান ডাইসন, পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান, ভারতের সুব্রহ্মনিয়াম চন্দ্রশেখর, পাকিস্তানের আবদুস সালাম, ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অমিয় বাগচী, তাঁর সহপাঠী জয়ন্ত নারলিকার, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিম মার্লিস প্রমুখ। হকিংয়ের কথা তো আগেই এসেছে।

১৯৮৪ সালে প্রফেসর ইসলাম তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। পশ্চিমের উন্নত দেশে ৩০ বছরের অভ্যস্ত জীবন, সম্মানজনক পদ, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, বিশ্বমানের গুণীজন সাহচর্য এবং আর্থিকভাবে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এলেন একেবারে নিজ জেলা চট্টগ্রামে। অতি দামি চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগ দিলেন মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে।
এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিল না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এর ভিন্নতা ঘটেনি কখনোই। আরেকটা দিক হলো বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থা সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব ছিল না।’

দেশে ফিরে এসে একদিকে জামাল নজরুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা রিচার্স সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (আরসিএমপিএস), যেটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে দেশের প্রবীণ পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর এ এম হারুন-অর রশিদ ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে আগত খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী, আপেক্ষিকতত্ত্ববিদ এবং বিশ্ব সৃষ্টি তাত্ত্বিকদের অবদান’ স্মরণ করে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রফেসর ইসলামের শ্রেষ্ঠ কীর্তি আখ্যা দিয়েছিলেন। এখানে তিনি উচ্চতর গবেষণার ছাত্রদের সহায়তার পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছেন, যাতে অনেক নোবেলজয়ীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের পণ্ডিতজন যোগ দিয়েছেন।

এসকল কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ তাঁকে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়৷

সুলতানা সারওয়াত আরা জামান: সুলতানা জামান ১৯৩২ সালের ৯ জুন ঝিনাইদহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার ইংরেজি মাধ্যম ডাইওসেসন স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হন। ভারত বিভাগের পর তাদের পরিবার চট্টগ্রামে চলে আসে।

তিনি ১৯৪৮ সালে অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে হলিক্রস কলেজে ভর্তি হন ও সেখান থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং সেখানে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৭২ সালে সুলতানা জামান ছিন্নমূল শিশু ও নারীদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে মালিবাগের গুলবাগে দীপশিক্ষা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাদান এবং প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে তিনি সোসাইটি ফর দ্য কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন ফর মেন্টালি রিটার্ডেড চিলড্রেন নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে সুইড বাংলাদেশ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮৪ সালে তিনি প্রতিবন্ধী বিশেষ করে প্রতিবন্ধী শিশু ও নারীদের নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।

সুলতানা জামান ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিশেষ শিক্ষায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে স্পেশাল এডুকেশন বিভাগ চালু হয়।এ উদ্যোগটি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম।

২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে তাকে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বার্তাবাজার/এইচ.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর