সিরাজগঞ্জে পুলিশ’র চাকরির আশায় নিঃস্ব পরিবার

১৬ হাত দৈর্ঘ্য আর ৮ হাত প্রস্থের ছোট্ট একটি ঘর। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরেও ঘরের ভেতরে আবছা অন্ধকার। ডান পাশে চুলা, থালা-বাসন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। বাঁ পাশে একটি চৌকি পৌষের শীতে কাঁথা মুড়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন ইমরান হোসেন এর বাবা রাজমিস্ত্রী আব্দুস সালাম।

তাঁর পাশে বসা ইমরানের ভগ্নিপতি লিখন বললেন, তিন দিন ধরে আমার শশুড়ের জ্বর। টাকার অভাবে ডাক্তার দেখানো হয়নি। একটু ওষুধও খাওয়াতে পারছি না।

এ করুণ দৃশ্য সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়া বেড়া ইউনিয়নের ধুলদিয়ার গ্রামের রাজমিস্ত্রী আব্দুস সালামের পরিবারের। কয়েক মাস আগেও সংসারের এই নাজুক অবস্থা ছিল না। তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। যা আয় হতো কোনো মতে খেয়েপরে ছেলে ইমরানকে পড়াশোনা করিয়ে পুলিশের চাকরির স্বপ্ন দেখতো।

সেই স্বপ্ন তার মনে বেশ জোরে শোড়েই উকি দেয় চলতি বছরে পুলিশ কনষ্টেবল নিয়োগ ২০১৯ প্রকাশ হলে। ছেলের ভবিষ্যৎ আলোকিত করার স্বপ্ন নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে একই ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের মৃত মান্না মন্ডলের ছেলে মজিবর মন্ডল ও সরাতৈল গ্রামের দিয়ারপাড়ার জামাল উদ্দিনের ছেলে আলহাজ দের একটি শর্ত পূরণ করলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে বলে জানতে পারেন। শোনা যায়, তারা নাকি অনেক উঁচু মানুষের সাথে চলাফেরা করে।

এদিকে রাজমিস্ত্রী আব্দুস সালাম তার ছেলেকে পুলিশে চাকরি করানোর স্বপ্ন দেখলেও মজিবর মন্ডল ও আলহাজ’র কাছে জানতে পারেন, এর জন্য দরকার ২০ লাখ টাকা। এত টাকা জোগাড় করতে বাড়ি বিক্রি করেন ৪ লাখ, কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণনেন ৫ লাখ, মেয়ের জামাই লিখন প্রামানিক এর ডিপিএস থেকে নেন ৬ লাখ ও সমিতি থেকে ৮% সুদে ৪ লাখ ৫৫ হাজারসহ মোট ১৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা তিন ধাপে তুলে দেন মজিবর মন্ডল ও আলহাজের হাতে।

যথরীতি চাকরী প্রার্থী ইমরান হোসেন শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, মনস্তাত্তিক ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হয় তার। সবশেষ, ৯ জুলাই নির্বাচিত ইমরানসহ ১৭৯জন তরুণ-তরুণীকে সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ সুপার আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে মিষ্টি খাইয়ে ও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। সেই সাথে নির্বাচিত ১৭৯ জনের মধ্যে শুধু বেলকুচি উপজেলা থেকে নির্বাচিত হয় ২২ জন। পরবর্তীতে ওই ২২জনকে বেলকুচি থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম ফুলদিয়ে ও মিষ্টি খাইয়ে শুভেচ্ছা জানান। কিন্তু বিধিবাম, অন্য নির্বাচিত সকলকে ট্রেনিংয়ের জন্য ডাকা হলেও ডাক পায়না ইমরান।

এ ঘটনার পর দালাল মজিবর ও আলহাজের কাছে টাকা ফেরত চায় ইমরানের পরিবার। এক পর্যায়ে ওই দুই দালাল জানায়, ঘুষের টাকার মধ্য থেকে ১৮লাখ ৫৫ হাজার টাকা তাদের আরেক অন্যতম সহযোগী একই ইউনিয়নের সড়াতৈল গ্রামের জিল্লুর মন্ডলকে দেয়া হয়েছে।

এমতাবস্থায় বারংবার ওই দালালদের টাকার জন্য তাগাদা দিলেও তারা টালবাহানা করতে থাকে। এনিয়ে গত প্রায় সাড়ে তিন মাসে ৭-৮টি শালিস বৈঠক হয়। ওইসব বৈঠকে এ দালাল চক্রটি টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করলেও টাকা না দিয়ে প্রতিবারই সময় চেয়ে নেয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর সাফ জানিয়ে দেয় তারা কোন টাকা পয়সা ফেরত দিতে পারবেনা। এ কথা শুনে ইমরান ও তার পরিবারের মাথায় এখন বাজ পড়েছে। গরিব অসহায় চাকরী প্রার্থী ইমরান হোসেন ও তার পরিবার দারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এদিকে সুদের টাকা দিতে না পেরে পরিবারের সদস্যরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভূক্তভোগী ইমরান ও তার পরিবার।

এ বিষয়ে সরেজমিনে গেলে স্থানীয় মাতবর হাজী শাহ আলম জানান, প্রথম দরবারটি আমার সারের দোকানে হয়েছে। সেখানে মজিবর ও আলহাজ ১৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ঘুষ বাবদ নিয়েছে বলে স্বীকার করে। পরে টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সে টাকা এখনও ফেরত দেয়নি।

৫নং ওয়ার্ড আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক জেলহক প্রামানিক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন বলেন, ইমরানের পরিবার অত্যন্ত গরীব। চাকরীর আশায় ঘুষের টাকা দিতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে পরিবারটি এখন মহাবিপদের মধ্যে রয়েছে।
এদিকে, দালাল আলহাজের সাথে বারবার মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সে ফোন রিসিভ করেনি। অপর দালাল মজিবর মন্ডল পুলিশে চাকরি দেয়ার জন্য টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলে, তার অন্যতম আরেক সহযোগী জিল্লুর মন্ডলকে ১৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকার মধ্য থেকে ১৮লাখ ৫৫হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। বাকী ১লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানায় সে। তবে, জিল্লুর মন্ডলের সাথে যোগাযোগ করা হলে সে বিষয়টি অস্বীকার করেন। এদিকে সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, হেপাটাইটিস বি পজিটিভ পাওয়ায় ইমরান স্বাস্থ্য পরিক্ষায় অযোগ্য হয়েছিলো।

বার্তাবাজার/কে.জে.পি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর