পেঁয়াজের নতুন সংকটের আশঙ্কা

এবারের সংকট কাটাতে গিয়ে পেঁয়াজের আগাম উত্তোলনে সর্বনাশ ঘটতে চলছে আগামী মৌসুমের ক্ষেত্রে। কৃষকরা সাময়িক আর্থিক লাভের জন্য যথেচ্ছভাবে তুলে ফেলছেন অপরিণত পেয়াঁজ। গ্রাম থেকে রাজধানী; পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে সব জায়গায়ই মিলছে গাছসহ ছোট আকারের অল্প ওজনের অপরিণত পেঁয়াজ। যার বেশির ভাগই মুড়িকাটা হলেও এর দেখাদেখি বীজের পেঁয়াজও অনেক এলাকায় লাগাতে না লাগাতেই বেশি দাম পাওয়ায় কৃষকরা তুলে ফেলছেন। এ নিয়ে কৃষিবিদরা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা জানিয়েছেন। তাগিদ দিয়েছেন বেপরোয়াভাবে অপরিণত পেঁয়াজ উত্তোলন নিয়ন্ত্রণের। নয়তো এবারের চেয়েও বড় পেঁয়াজ সংকট দেখা দেবে কয়েক মাস না যেতেই।

এমন আশঙ্কা মাথায় রেখেই প্রথমবারের মতো দেশে ব্যাপকভাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উত্পাদনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

কৃষিসচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে কৃষকরা বেশি দাম পাওয়ার আশায় যে যেভাবে পারছে অপরিণত পেঁয়াজ বিক্রি করছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে জেনেও আমরা তাদের এটা না করতে বলতে পারি না। তাদের লাভের দিকটাও দেখতে হবে। বরং আগাম বা অপরিণত উত্তোলনসহ পেঁয়াজের নানামুখী ঘাটতি মোকাবেলায় আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা নিয়েছি এবং তা বাস্তবায়নও শুরু করে দিয়েছি।’

সচিব জানান, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রথমত চলতি মৌসুমের জন্য পূর্বনির্ধারিত পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত আরো চাষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন জাতের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ সংগ্রহের কাজও শুরু হয়ে গেছে। শীতকালীন পেঁয়াজ উঠে যাওয়ার পর মে মাস থেকে জমিতে লাগানো হবে এই গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ। এ ছাড়া ধান-চালের মতো

নতুন জাতের উত্পাদিত পেঁয়াজও কৃষকের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামে কিনে নেবে। পরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে একদিকে যেমন বিনা মূল্যে বিতরণ করা হবে, তেমনি এর বীজ বিনা মূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুল মুঈদ বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুসারে এ বছরই প্রথম পেঁয়াজ চাষিদের মধ্যে বিনা মূল্যে সার ও বীজ বিরতণ করছি। এতে কৃষকরা পেঁয়াজ চাষে আরো উৎসাহিত হবে। অতিরিক্ত পেঁয়াজ উত্পাদন হলে অপরিণত পেঁয়াজ উত্তোলনে যে ঘাটতি আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটাও অনেকটা কেটে যাবে।’

সরকারের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, পেঁয়াজের সংকটজনক পরিস্থিতির সুযোগে ও বেশি দাম পাওয়ায় কৃষকরা পরিণত আকার ও ওজন হওয়ার আগেই ব্যাপকহারে অপরিণত ছোট পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছে। মানুষও সাময়িক প্রয়োজন মেটাতে হাতের কাছে যে পেঁয়াজ যতটুকু কম দামে পাচ্ছে তা কিনে নিচ্ছে। কিন্তু এটা সামনের আরেক ভয়াবহ সংকটময় পরিণতির আশঙ্কা তৈরি করছে। সেই সঙ্গে কৃষকরাও একইভাবে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে পরিণত আকারের যে কয়টি পেঁয়াজে এক কেজি হয়, ছোট অপরিণত এক কেজি পেঁয়াজে এখন তার চেয়ে দ্বিগুণ বা ক্ষেত্রবিশেষ তারও বেশি লাগছে।

এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, এখন যে পেঁয়াজ গাছসহ বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো বেশির ভাগই মুড়িকাটা পেঁয়াজ (কাটা পেঁয়াজ থেকে উত্পাদন হওয়া), এগুলো সাধারণত বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। তার পরও বছরের মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এখন প্রায় ১৫-২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে এই মুড়িকাটা পেঁয়াজ। আগে যা আরো বেশি ছিল। এ ছাড়া আমাদের দেশে যে পেঁয়াজ সারা বছর থাকে সেগুলো মূলত বীজের পেঁয়াজ। এর পরিমাণ বেশি। এখন যদি কৃষকরা মুড়িকাটা পেঁয়াজের দেখাদেখি বীজের পেঁয়াজও লাগানোর পর ছোট আকারেই উত্তোলন করে বিক্রি করে দেন তবে সামনে কিন্তু ভয়ানক সংকট দেখা দেবে। বিশেষ করে এবার যেমন বছরের শেষ সময়ে এসে সংকট দেখা দিয়েছে, আগামীবার কিন্তু অর্ধেকও যাবে না। পরিমাণগত সংকট প্রকট হয়ে উঠবে। তাই এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করা ও যথেচ্ছভাবে অপরিণত পেঁয়াজ উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. আব্দুল ওহাব বলেন, যেভাবে আগাম উত্তোলন করা হচ্ছে তা যদি নিয়ন্ত্রণ করে আর মাত্র ১৫-২০ দিন পরেও উত্তোলন করা যায় তবে কিন্তু কৃষকরাই আরো লাভবান হবেন আর পরিমাণগত সংকটও থাকবে না। নয়তো এবার কিন্তু পরিমাণগত উত্পাদনের বড় ঘাটতি হবে। এ জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা উচিত। এ ছাড়া পেঁয়াজ সংরক্ষণেও আরো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি পেঁয়াজ মৌসুমে মোট দুই লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুসারে ৩১ শতাংশ চাষাবাদ সম্পন্ন হয়েছে।

বার্তাবাজার/কে.জে.পি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর