দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী যমুনা মরা নদীতে পরিণত

বিভিন্ন নদীর উৎসমুখে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী যমুনা মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। যমুনার প্রবাহ কমে যাওয়ায় সঙ্কুচিত হয়েছে নৌপথ। যমুনা সংযুক্ত ২০টি শাখা-উপশাখা নদী শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। কমেছে মাছ ও জলজ প্রাণী। পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি অর্থনীতি ও জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় যমুনার বুকে এখন দৃশ্যমান অসংখ্য বড় বড় চর।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, ১৫ বছর আগে যমুনা নদী দিয়ে যেসব কার্গো জাহাজ চলত এখন আর সেই বিশাল কার্গো জাহাজগুলো চলতে পারে না। আগে যেখানে ১২ ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলতো এখন সেখানে ছয় ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করতে পারে। ২৫ বছর আগের চেয়ে এখন নৌপথ কমে অর্ধেক হয়েছে। তিস্তা প্রবাহ কমে যাওয়ায় যমুনা হয়ে তিস্তায় আর কোনো নৌযান চলাচল করতে পারে না।

বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ ড. শহিদুল করিম মুকুল বলেন, তিস্তা দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদী। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা এ নদী শুধু পানি নয় প্রচুর পরিমাণে পলিমাটি নিয়ে আসে। তিস্তা উত্তরাঞ্চলের সেচকাজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, উদ্ভিদরাজি, পুরো ইকোলজিক্যাল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে। ভৌগলিকভাবে তিস্তা অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এই অঞ্চলের ভূঅভ্যন্তরের জলাধারে পুনঃসরবরাহের জন্য তিস্তার পানি একান্ত প্রয়োজন। তিস্তার পানি কমে গেলে এই এলাকার অন্যান্য ছোট ছোট নদীও শুকিয়ে যাবে। এ জন্য তিস্তার পানির সরবরাহ বাংলাদেশের বাস্তব ব্যবস্থার জন্য মৃত্তিকার ঊর্বরতার জন্য জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য একান্ত প্রয়োজন। তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেয়া অনৈতিক।

ভারত সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের উন্নয়ন পরিকল্পনা মোতাবেক এ নদীর ওপর ১৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব বাঁধ প্রকল্প পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করবে। প্রকল্পগুলোর জন্য মূল ব্রক্ষপুত্র নদে ও এর শাখা নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণ এবং ব্যাপকহারে পানি প্রত্যাহার করতে হবে। তিস্তার ভারত অংশের একেবারে ভাটিতে বাংলাদেশের কাছে ব্যারেজ নির্মাণ ও ডাইভারশন খাল কেটে মহানন্দা নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এই প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের বেলায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ ভূমিতে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি।

ভারত ব্রক্ষপুত্র নদকে ঘিরে ১২টি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ শেষ হয়েছে চারটি, বাস্তবায়নাধীন রয়েছে তিনটি ও পরিকল্পনাধীন রয়েছে আরও পাঁচটি। সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। রিভারলিংকিং প্রজেক্টে ব্রক্ষপুত্র নদকে ঘিরে ভারত যেসব প্রকল্প গড়ে তুলেছে বেশির ভাগই হচ্ছে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক গঙ্গা-ব্রক্ষপুত্র দুটি নদী অববাহিকায় পানির ৩৩টি জলাধার নির্মাণ করবে। প্রতিটি জলাধারের পানি ধারণক্ষমতা হবে এক লাখ ৫০ হাজার কিউসেক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. সরওয়ার জাহান সজল বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ কমে আসবে। শুকনো মওসুমে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পানির উৎস। এই নদ দিয়ে পানি আসা কমে গেলে বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। ভারত চাইলে একতরফাভাবে যৌথ নদীর ওপর এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। পানি সমস্যা দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করা যাবে না। নেপালে জলাধার নির্মাণ করে হিমালয়ের পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কার পানি প্রবাহ এক লাখ ৩০ হাজার কিউসেক থেকে এক লাখ ৯০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাতে সবাই লাভবান হবে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুন নেছা বলেন, ভারত কোনো বিশেষ এলাকার মানুষের ক্ষতির চেয়ে সাময়িক লাভালাভকেই অগ্রাধিকার দিতে চায়। এখনই বিদ্যুৎ চাই, সেচের পানি চাই, এই চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও তারা এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এতে প্রতিবেশী দেশের কোনো বিপর্যয়কে তারা আমলে নিতে চায় না। গঙ্গার পানি বণ্টনের সঙ্গে তিস্তা, ব্রক্ষপুত্রসহ অন্যান্য নদীর বিষয়ও আলোচনাভুক্ত করতে হবে।

বার্তাবাজার/কে.জে.পি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর