শৈত্যপ্রবাহে বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট

চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানা এলাকার জেনারেল পোস্ট অফিস ভবনের নিরাপত্তা দেয়াল ঘেষে ফুটপাতে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ছেঁড়া বস্তা মুড়িয়ে বসেছিলেন রাজিয়া বেগম (৩২)। প্রচণ্ড শীতে তখন কাঁপছিলেন তারা থরথর করে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে।

তখনও ওই এলাকায় বয়ে চলেছে কনকনে শৈত্য প্রবাহ। এতেই কাবু মা ও দুই শিশু সন্তান। এর মূল কারন তাদের গায়ে নেই কোন গরম কাপড়। রাজিয়া বেগমের পরনে ছেড়া পাতলা একখানা সুতার কাপড়। দুই শিশুর গায়ে দুটি ছেড়া গেঞ্জি মাত্র।

নিরুপায় হয়ে কুড়িয়ে পাওয়া ছেঁড়া বস্তা মুড়ি দিয়ে বসে আছেন তারা। হতাশার এমন বানী শুনালেন রাজিয়া বেগম। এসময় তার দুই শিশু সন্তান শুধু তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাদের চেহারাও যেন ভেসে উঠে শীতের কষ্টের আকুতি। তাদের নাক-মুখের হাঁচিও বলছে তাই।

রাজিয়া বলেন, তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানা এলাকায়। দুই শিশুই কন্যা হওয়ায় স্বামী তালাক দেয়। এরপর গত দুই মাস আগে চট্টগ্রামে আসেন তিনি। এরমধ্যে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রচণ্ড শীতে তার ভোগান্তি ও কষ্ট দুটোই বেড়েছে বহুগুণে। দুই সন্তানকে নিয়ে কাটাতে হচ্ছে নির্ঘুম রাত।

সেই সাথে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হাঁচি-কাশিসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রকোপ। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তার। এর আগে সকাল ৭টায় শীতে জবুথবু হয়ে নগরীর চকবাজার মোড়ে বসেছিলেন দিনমজুর মশিউর রহমান (৪৪), আলাউদ্দিন (৩৯) ও মো. জসিম (৩৪)। তারা বলেন, প্রতিদিন ভোর হতেই কাজের সন্ধানে ছুটে আসি এখানে। কিন্তু শীত বাড়ার পর থেকে গত ২ দিন ধরে হাতে কোনো কাজ নেই। আয় না হওয়ায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। চুলায় আগুন জ্বলছে না।

একইভাবে সকাল ৯টায় নগরীর টাইগার পাস মোড়ে বস্তিতে বসবাস করা কয়েকটির পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর প্রচন্ড শীতে কাঁপছিলেন। এরমধ্যে কেউ গাছের শুকনো পাতা, কুড়ানো কাগজ ও পলিথিন পুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছিলেন।

তাদের অনেকের শরীরের ছিল না গরম কাপড়। ফলে শীতে তাদের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়ার কথা জানান তারা। এরমধ্যে ষাটোর্ধ আয়েশা খাতুন জানান, অর্থাভাবে শীত মোকাবিলার সাধ্য তাদের কারো নেই। এখনও পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে তাদের কেউ কোনরকম শীতবস্ত্র দেননি। শীতবস্ত্র শুধু রাস্তায় বিতরণ করা হয়, বস্তিতে বিতরণ করা হয় না বলে জানান তিনি।

তিনি অভিযোগ করেন, রাস্তার মোড়ে যারা শুয়ে থাকে তাদের শীতবস্ত্র দেওয়া হয়। একাধিক শীতবস্ত্র পেয়ে তারা তা বিক্রি করে দেশে টাকা পাঠায়। আমরা শীতে মরি, আমাদের গরম কাপড় দেওয়া হয় না।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমরা ফুটপাতে বিতরণের চেয়ে এবার বস্তিতে শীতবস্ত্র বিতরণের ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। কারণ ফুটপাতে দেখা যায়, একই লোক বারবার পাচ্ছে। এদের অনেকেই এগুলো সংগ্রহ করে পরে মার্কেটে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। সে অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে।

সে কারণে এখন রাতে না দিয়ে দিনে বস্তিতে গিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। তিনি জানান, চট্টগ্রাম জেলা ও উপজেলার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে এবার ১ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ কম্বল বরাদ্দ পেয়েছি। এর মধ্যে গত সপ্তাহে আমরা সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ৪৬০টি করে কম্বল পাঠিয়েছি ছিন্নমূলদের মধ্যে বিতরণের জন্য। এগুলো কাউন্সিলররা বিতরণ করবেন।

এছাড়া ১২-১৩ হাজার কম্বল আমাদের কাছে স্টক রয়েছে। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে সেগুলোও ভাসমান মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে। এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকেও চট্টগ্রামে বইয়ে চলেছে শৈত্য প্রবাহ। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। বিকাল হতেই বইছে ঠান্ডা বাতাস। এই শীত কারও জন্য আনন্দ আর উপভোগের হলেও ছিন্নমূল ও নিন্মআয়ের মানুষের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ শীত মোকাবিলার পর্যাপ্ত জামা-কাপড় যেমন তাদের নেই, তেমনি সাধ্যও নেই।

পতেঙ্গা আবহওয়া অফিসের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার থেকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয় চট্টগ্রামে। এরমধ্যে গত শনিবার চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। ওইদিন সর্বনিন্ম তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম।

আগেরদিন শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ২১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। একইদিন রেকর্ড হওয়া সর্বনিন্ম ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম।

চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন জানান, এবারের শৈত্যপ্রবাহ মৃদু ধরনের হলেও এর প্রভাবে তীব্র শীতে এখনও কাঁপছে দেশ। তবে ডিসেম্বরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে প্রভাবশালী শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এ সময় মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে।

তিনি বলেন, ২৫ ডিসেম্বরের দিকে বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টির পর রাতের তাপমাত্রা কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিক্ষিপ্তভাবে মৃদু আকারে শৈত্যপ্রবাহও আসতে পারে। ২৭ থেকে ২৮ ডিসেম্বরের দিকে এই শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে।

বার্তাবাজার/কেএ

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর