শহীদের সংখ্যা বিতর্ক: ৩ লাখ নাকি ৩ মিলিয়ন?

শহীদের সংখ্যা বের করার আগে আমাদের জানতে হবে শহীদের সজ্ঞাঃ

শহীদের ধর্মীয় সজ্ঞাঃ
শহীদ একটি ইসলামী পরিভাষা। ধর্মের জন্য কিংবা সত্য ও ন্যায়ের জন্য জীবন উৎসর্গকারীকেই শহীদ বলে।
১৯৭১ এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষ ছিলো একটি,বঞ্চিত এ জাতির স্বাধীকার আন্দোলনের সৈনিকেরা।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে মুসলমান
(১) তার দ্বীনের জন্য নিহত হ’ল, সে শহীদ
(২) যে তার জীবন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ
(৩) যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ
(৪) যে ব্যক্তি তার পরিবার রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ।
তিনি আরও বলেন,
(৫) যে ব্যক্তি মহামারীতে মারা যায়, সে শহীদ,
(৬) যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় (কলেরা, ডায়রিয়া) মারা যায়, সে শহীদ,
(৭) যে ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়, সে শহীদ’।
(৮) যে ব্যক্তি মযলূম অবস্থায় নিহত হয়, সে শহীদ’।
(৯) যে ব্যক্তি তার ন্যায্য অধিকার রক্ষায় নিহত হয়, সে শহীদ’।

হযরত সাঈদ বিন যায়েদ থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- ”যে ব্যক্তি নিজ সম্পত্তি রক্ষায় নিহত হয় সে শহীদ। যে ব্যক্তি নিজ পরিবার রক্ষায় নিহত হয় সেও শহীদ। অথবা প্রাণ রক্ষায় কিংবা দ্বীন রক্ষায় নিহত হয় সেও শহীদ। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৭৭৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৬৫২)

*আন্তর্জাতিক শহীদের সজ্ঞাঃ
যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ আক্রান্তের কারণে যারা মারা যাবে তারা সবাই শহীদ। (খাদ্যাভাব, চিকিৎসা, বিশুদ্ধ পানি )

আসুন যেনে নেই শহীদের সংখ্যা ৩ মিলিয়ন নাকি ৩ লাখ।

বঙ্গবন্ধু দেশে আসার আগ পর্যন্ত, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন ব্যাক্তিরা কী বলছে শহীদ বা হতাহতের সংখ্যা নিয়ে?

*১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামের নরঘাতকরা এদেশের স্বাধীনতাকামী আপামর জনতার রক্তের নেশায় মেতে উঠেছিলো। তাদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন জাতির শ্রেষ্ট সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ন্যায়ের পথে তারা দেশমাতৃকার প্রেমে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাই আমরা তাদের পরম ভক্তিভরে “শহীদ” বলি।

*পৃথিবীতে গগণহত্যার সংখ্যা বের করা হয় জনসংখ্যার ঘাটতি অনুযায়ী।
অর্থাৎ দেশে কোন ধরনের দুর্যোগ সৃষ্টি হলে তার প্রভাব জনসংখ্যার উপর পড়ে।

*জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ও ত্রিশ লাখ শহীদ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মৃত্যুহার অগণিত হারে বেড়ে যায়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ওপর জাতিসংঘের রিপোর্ট থেকে জানা যায়,

-১৯৫০-৫৫ সালে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৬,
-১৯৫৫-৬০ সালে ১৫.৩,
-১৯৬০-৬৫ সালে ১৫.৩,
-১৯৭০-৭৫ সালে হঠাত্ এটা হয়ে যায় ৫.৫,
আবার ১৯৭৫-৮০ সালে ১৪.২,
-১৯৮০-৮৫ সালে ১৪.৫ এভাবে চলছে।

*সত্তর থেকে পঁচাত্তরের ভেতর স্বাভাবিক জন্মহার বিবেচনায় তাহলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫ লাখ!

১৯৫০-১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রতি ৫ বছরে

জনসংখ্যা গড়ে ১৫.৩% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে

যদি ১৯৭০-১৯৭৫ সালে জনসংখ্যা এই হারে (১৫.৩/৫ বছর)

বৃদ্ধি পেত তাহলে ১৯৭৫ সালে জনসংখ্যা দাঁড়াত ৭৭১ লাখ

অর্থাত্ ১৯৭০-১৯৭৫ সালে আমাদের দেশ থেকে
হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৭কোটি ৭১ লাখ -৭কোটি ০৬ লাখ = ৬৫ লাখ
আচ্ছা এই মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। আসুন দেখি উল্লেখযোগ্য কী কী ঘটনা ঘটেছিল এই পাঁচ বছরে, যেটা এত মৃত্যু কিংবা হারিয়ে যাওয়া মানুষ কোথায় গেলো??

১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩৩ তম বছর উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১-এর গণহত্যা স্বল্পতম সময়ে সর্ববৃহত্ সংখ্যা।
গড়ে প্রতিদিন ৬০০০ থেকে ১২০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। দেখা যায় যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, এই মোটামুটি ২৬০ দিনে দিনপ্রতি ৬০০০-১২০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এই তথ্যটি দিয়ে একটু হিসাব করলে দেখা যাবে হত্যার সর্বনিম্ন সংখ্যা: ৬০০০ ঢ ২৬০=১৫,৬০০০০ (পনের লাখ ষাট হাজার) এবং সর্বোচ্চ সংখ্যা: ১২০০০ ঢ ২৬০=৩১,১২০০০ (একত্রিশ লাখ বারো হাজার)। আমরা যদি এই পরিসংখ্যানের মাঝামাঝি ধরে হিসাব করি তাহলে এ সময় মৃত্যুর সংখ্যা ২৩,৪০০০০ (তেইশ লাখ চল্লিশ হাজার)।

লন্ডন স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. রহমতুল্লাহ তার বই থেকে – বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পরে জনসংখ্যার ঘাটতি হয় ৭৬ লক্ষ মানুষের। (৭০-৭৫) সাল পর্যন্ত।
এর মধ্যে ৭০ এর দুর্ভিক্ষ, ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৫৫ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে।
যুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা কারণে যতজন মারা যায় সবাই কে শহীদ হিসাবে ধরা হয়েছে।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১ কোটি মানুষ ভারতে শরনার্থী হিসেবে চলে যায়।
২২ জুন ১৯৭১ আমেরিকার বিখ্যাত সংবাদ মাধ্যম ডেইলি নিউজ জানায় মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে ভারতে পালিয়ে যায় ৪০ লাখ মানুষ। এবং ঐ ৩ মাসেই বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে ৬ লাখ মানুষ কলেরা, খাদ্যাভাব, চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।
এবং পরবর্তী ৬ মাসে ভারত যায় আরও ৬০-৮০ লাখ মানুষে। যাদের মধ্যে ৯ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় বলে ধারণা করেন তারা।

*শরণার্থী শিবিরে সত্যিকার অর্থে থেকে যাওয়া মানুষের সংখ্যাটা বের করা আসলে সম্ভব না, যদিও দ্য হিন্দু পত্রিকার ৬ প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, ৯২ লাখ শরণার্থী দেশে ফিরেছে ১৯৭২ সালের মার্চের ভেতরেই। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বলছে:

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী ভারতে গমন করেন। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৪১টি শরণার্থী শিবির স্থাপিত করা হয়। এই শিবিরগুলিকে মোট ৯,৮৯৯,৩০৫ বাংলাদেশী আশ্রয় গ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গে ৭,৪৯৩,৪৭৪, ত্রিপুরাতে ১,৪১৬,৪৯১, মেঘালয়ে ৬৬৭,৯৮৬, আসামে ৩১২,৭১৩ ও বিহারে ৮৬৪১ সংখ্যক বাংলাদেশী শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেন।’ অর্থাত্ প্রায় সাত লাখ শরণার্থী ফিরে আসেননি।

এই তিন উউৎস থেকে আমরা দেখি মোট হারিয়ে যাওয়া/মৃত মানুষের সংখ্যা (৭+৭.৫+৫) অর্থাত্ ১৯.৫ লাখ। এবার আমাদের হাতে থাকা ৬৫ লাখ থেকে বাদ পাচ্ছি ৪৫.৫ লাখ মানুষ নিখোঁজ/ নিহত।
দেশ ত্যাগ ও আসার সময় যারা মারা গেছে তাদের হিসাব পাওয়া যায়নি।
এসব বিভ্রান্তির জবাব নির্মোহভাবে দিতে পারে মুক্তিযুদ্ধের ওপর করা বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা। যেখানে গণহত্যার পর হতাহতের সংখ্যা বের করার গাণিতিক সূত্র মেনে মৃত মানুষের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হওয়া অনেকগুলো গবেষণা থেকে কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করব আমরা।

১ সেন্টার ফর সিস্টেমেটিক পিস’-এর ডিরেক্টর ড. মার্শাল জোবি, ‘মেজর এপিসোডস অব পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স ১৯৪৬-২০১৪’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১০ লাখ

২. ড. টেড রবার্ট গার এবং ড. বারবারা হার্ফ দুজন গণহত্যা গবেষক। এঁদের মাঝে ড. টেড রবার্ট গার বর্তমানে ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ড. বারবারা হার্ফ ইউএস নেভি একাডেমিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। তাঁরা দুজনই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দিকপাল হিসেবে পরিচিত। তাঁদের বিখ্যাত গবেষণা, যেটা পরবর্তী সময়ে পুস্তক হিসেবেও সমাদৃত হয়, টুয়ার্ড অ্যাম্পিরিক্যাল থিওরি অব জেনোসাইডস অ্যান্ড পলিটিসাইডস, প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। সেই বইতে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ১২,৫০,০০০ থেকে ৩০,০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে।

৩. মিল্টন লিটেনবার্গের গবেষণাপত্র, যেটা প্রকাশিত হয় কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ‘ডেথস ইন ওয়ারস অ্যান্ড কনফ্লিক্টস ইন দ্য ২০ত সেনচুরি’ শীর্ষক সেই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন অর্থাত্ ১৫ লাখ।

৪. ড. জ্যাক নুস্যান পোর্টার একজন লেখক, গবেষক, সমাজকর্মী এবং যিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, তাঁর সাড়া জাগানো বই জেনোসাইড অ্যান্ড হিউমেন রাইটস। এই বইতে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শহীদের সংখ্যা ১০ থেকে ২০ লাখ।

৫. ১৯৪৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে ৩০০টি আন্তর্জাতিক সংঘাত সম্পর্কে বলা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট: আ ক্রোনোলজিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব কনফ্লিক্টস অ্যান্ড দেয়ার ম্যানেজমেন্ট, ১৯৪৫-১৯৯৫ বইটিতে। লেখকদ্বয় জ্যাকব বারকোভিচ এবং রিচার্ড জ্যাকসন দুজনেই আন্তর্জাতিক সংঘাত বিশেষজ্ঞ।

৬. গণহত্যা গবেষক টম হার্টম্যান এবং জন মিচেল তাঁদের লেখা আ ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অব মিলিটারি হিস্টিরি, ১৯৪৫-১৯৮৪ বইতে বলেছেন একাত্তরের যুদ্ধে দশ লাখ মানুষ মারা যায়।

৭. ওয়ার্ল্ড অ্যালামন্যাক, যাদের বলা হয়ে থাকে তথ্যপঞ্জির জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ, তারা তাদের বেস্ট সেলার ১৯৮৪ সালের সংখ্যায় বলেছে, ১৯৭১ সালের সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ১০ লাখ।

৮. কম্পটনস এনসাইক্লোপিডিয়া তাদের গণহত্যা পরিচ্ছদে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা লিখেছে ৩০ লাখ।

৯. এনসাইক্লোপিডিয়া অ্যামেরিকানা তাদের ২০০৩ সালের সংস্করণে বাংলাদেশ নামক অধ্যায়ে একাত্তরে নিহত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ত্রিশ লাখ।

১০. গণহত্যা গবেষক লিও কুপার তাঁর বিখ্যাত জেনোসাইড বইতে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে।

১১.১৯৮১ সালের জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩৩তম বছর উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে ‘মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যা স্বল্পতম সময়ে সর্ববৃহত্। গড়ে প্রতিদিন ৬,০০০ থেকে ১২,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এটি হচ্ছে গণহত্যার ইতিহাসে প্রতিদিনে সর্বোচ্চ নিধন হার। এই ঘোষণা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার প্রায় দশ বছর পরে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং গণহত্যা যে ২৬৬ দিন চলেছিল তারা সেটা জানত। রাউন্ড ফিগার ২৬০ দিন ধরে বাঙালি নিধন হয়েছে ১৫,৬০,০০০ থেকে ৩১,২০,০০০ পর্যন্ত।

১২. পুলিত্জার পুরস্কার বিজয়ী আ প্রোবলেম ফ্রম হেল: অ্যামেরিকা অ্যান্ড দ্য এইজ অব জেনোসাইড গ্রন্থের লেখিকা সামান্তা পাওয়ার পৃথিবীর বিভিন্ন গণহত্যার খতিয়ান বের করেছেন। বেস্ট সেলার এই বইটিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০ থেকে ৩০ লাখ।

১৩. বিশিষ্ট রাজনীতিবিজ্ঞানী রুডল্ফ জোসেফ রুমেলের স্ট্যাটিসটিকস অব ডেমোসাইড বইটিকে দাবি করা হয়ে থাকে বিশ্বে গণহত্যা নিয়ে সংখ্যাগতভাবে অন্যতম কমপ্রিহেনসিভ বই। বইটির অষ্টম অধ্যায়ে স্ট্যাটিসটিকস অব পাকিস্তান’স ডেমোসাইড এস্টিমেইটস, ক্যালকুলেশনস অ্যান্ড সোর্সেস নিবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামে ১৫,০৩,০০০ থেকে সর্বোচ্চ সম্ভাবনার ঘরে ৩০,০৩,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি বিভিন্ন সময় সংখ্যাটা ১৫ লাখ বলেই উল্লেখ করেছেন। অনেকের মনে খটকা লেগে থাকতে পারে যে বেশির ভাগ গবেষকের মতে, সংখ্যাটা ১০ থেকে ১৫ লাখের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের উদ্দেশে বলছি, গল্পটা এখানেই শেষ হয়নি। শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষের বেশির ভাগ গবেষক গণনায় আনেননি। এক কোটি বিশ লাখ মানুষের স্থানান্তরে প্রচুর মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। আমাদের ধারণা অনুসারে কেবল শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষের সংখ্যাই ৬ থেকে ১২ লাখ হতে পারে। এ ছাড়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. রিচার্ড ক্যাস বলেছেন:

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর রিসাড ক্যাস বলেছেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরে, খাদ্যাভাব, চিকিৎসা, সহ নানা কারণে ৫ লাখের অধিক মানুষ মারা গেছে।
জিউফ্রি ডেভিডের বই Changing pace of genocide এ উল্লেখ করেছেন, যুদ্ধ পরবর্তীতে ১ লাখ বীরাঙ্গনা আত্নহত্যা করছে। যাদেরকে পরিবার, সমাজ মেনে নেয়নি।

*ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং (ডব্লিউসিএফসি) এ দেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছে। তারা জানিয়েছে, এই সংখ্যাটা এখানেই শেষ হয়নি। এর মধ্যে কেবল চট্টগ্রামেই আছে ১১৬টি। এ ছাড়া দেশের আনাচকানাচে সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে আরও অগণিত বধ্যভূমি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন ৭ জানান, স্বাধীনতার পর এ বধ্যভূমির শুধু একটি গর্ত থেকেই প্রায় ১ হাজার ১০০ মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। সংগৃহীত কঙ্কাল এখনো সংরক্ষিত রয়েছে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের স্মৃতি অম্লান জাদুঘরে।

*যুদ্ধ পরবর্তীতে গণহত্যা কমিশন ৫৪ জেলায় একটা একটা করে মাথায় খুলি গণনা করে বের করে ১২ লাখ ৪৮ হাজার। (অসামাপ্ত)

ড. সুকুমার বিশ্বাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অন্যতম গবেষক। বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি সারা দেশে ঘুরেছেন এবং একাত্তরের বধ্যভূমি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁর অনেক লেখায় তিনি বলেছেন, রাজশাহীর একটি বধ্যভূমিতে একশটি গণকবর থেকে দশ হাজার মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। গল্লামারী বধ্যভূমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে পাশেই অবস্থিত। একাত্তরে খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী খাল ও এর আশপাশের স্থান থেকে প্রায় পাঁচ ট্রাক ভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ওই স্থানে আনুমানিক ১৫০০০ মানুষ হত্যা করা হয়। এ রকম অনেক অনেক আছে অথচ রায়েরবাজার এবং জল্লাদখানার মতো বিখ্যাত বধ্যভূমির মোট লাশের সংখ্যা কখনোই নির্ণয় করা সম্ভব হবে না। তারপরও আমরা যদি না পাওয়া বধ্যভূমির কথা হিসাব করে সর্বসাকল্যে মোট ১০০০ বধ্যভূমির সংখ্যা ধরে নিই এবং প্রতি বধ্যভূমিতে ১০০০ করে লাশ থাকলে তাহলেই বধ্যভূমিতে মোট প্রাণ হারানো বাঙালির সংখ্যা হয় ১০ লাখ। এ ছাড়া নদীমাতৃক দেশে হাজার হাজার মানুষকে নদীর পাড়ে নিয়ে এসে হত্যা করা হয়েছে,

*মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো ‘চরমপত্র’। সেই চরমপত্রের শেষ প্রচার দিবস অর্থাত্ ১৬ ডিসেম্বরের কিছু অংশ সরাসরি তুলে দিচ্ছি:

২৫ মার্চ সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালিগো বেশুমার মার্ডার করনের অর্ডার দিয়া কি চোটপাট! জেনারেল টিক্কা খান সেই অর্ডার পাইয়া ৩০ লাখ বাঙ্গালির খুন দিয়া গোসল করল। তারপর বঙ্গাল মুলুকের খাল-খন্দক, দরিয়া-পাহাড়, গেরাম-বন্দরের মইদ্দে তৈরি হইল বিচ্ছু…’ (চরমপত্র; পৃ: ৩২৫)।

মাওলানা ভাসানী যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই দশ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছিলেন। কবি আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছেন তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা। সেসব কবিতায় বারবার উঠে এসেছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর দুটো কবিতার কথা উল্লেখ করছি। আসাদ চৌধুরী তাঁর ‘রিপোর্ট ১৯৭১’৩ কবিতার ৫৪ নাম্বার লাইনে লিখেছেন ১০ লাখ গলিত লাশের কথা:

চলুন একটু দেশী-বিদেশী পত্র পত্রিকা দেখে আসিঃ

১. টাইমস একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই লিখেছে ৩ লাখ ছাড়িয়েছে এবং বাড়ছে।

২. নিউজউইক এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৭১ লিখেছে সাত লাখ।

৩. দ্য বাল্টিমোর সান ১৪ মে ১৯৭১ লিখেছে ৫ ল

৪ দ্য মোমেন্টো, কারাকাস জুনের ১৩ তারিখে লিখেছে ৫ থেকে ১০ লাখ।

৫. কাইরান ইন্টারন্যাশনাল ২৮ জুলাই লিখেছে ৫ লাখ।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২৩ জুলাইয়ে রিপোর্ট করেছে, সংখ্যাটা ২ থেকে ১০ লাখ।

৭. টাইমস সেপ্টেম্বরে বলছে ১০ লক্ষাধিক।

৮. দ্য হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট এক্সপ্রেস, লন্ডন ১ অক্টোবর ১৯৭১ বলেছে শহীদের সংখ্যা ২০ লাখ।

৯ ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে লিখেছে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ।

যেমন দৈনিক পূর্বদেশ-এর সম্পাদক তাঁর পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘ইয়াহইয়া জান্তার ফাঁসি দাও’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে পরিষ্কার লেখা হয়, ‘হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দুশতাধিক বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে…’।

এরপর রাশিয়ার প্রাভদা, ৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ ত্রিশ লাখের কথা উল্লেখ করে।

মর্নিং নিউজ, ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ ত্রিশ লাখের কথাই আবার উল্লেখ করে সেই সংখ্যাটা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়।

ঢাকার পত্রিকা দৈনিক অবজারভার শিরোনাম করে এভাবে, ‘পাক আর্মি কিল্ড ওভার ৩০ লাখ পিউপল’, যেটা প্রকাশিত হয় ০৫.০১.১৯৭২ তারিখে মুজিব দেশে আসার ৩ দিন আগে।

৪ জানুয়ারি আজাদ পত্রিকাও প্রাভদার কথা উল্লেখ করে তাদের সংবাদে। দৈনিক বাংলা পত্রিকা তাদের, ৬ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘জল্লাদের বিচার করতে হবে’ শিরোনামে করা প্রবন্ধ ত্রিশ লাখ শহীদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। যেটা প্রকাশিত হয় ৮ তারিখের আগে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু মুক্তির আগেই

সত্যি বলতে সংখ্যাটা ত্রিশ লাখ, তিন লাখ, এক লাখ অথবা ছাব্বিশ হাজার যাই হোক না কেন, এটা তো অবশ্যই এক বাক্যে মানতে হবে যে সংখ্যাটা অনেক বড়। সংখ্যাটা যে অনেক বড়, সেটা এমনকি এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা জেনারেল রাও ফরমান আলী

তথ্য সংগ্রহ

স্বাধীনতার চরম পত্রে
*খালেদ মোশাররফের জার্নাল টিভিতে সাক্ষাৎকার

*অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস এর দ্যা রেপ অব বাংলাদেশ

ড. রহমতুল্লাহ লন্ডন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক
*রির্সাড ক্যাস প্রফেসর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি

ড. ব্রাউন মিলার, Change pace of Genocide
*Google
http://www.bangla2000.com/Bangladesh/Independence-War/Report-Hamoodur-Rahman/default.
https://abrittiokobita.wordpress.com/2014/06/09/%E0%A6%B0
প্রথম আলো

লেখক ও তথ্য সংগ্রাহক:
মোআয়কর আইনজীবি
সদস্য ঢাকা ট্যাক্স বার এসোসিয়েশন
সদস্য আবৃত্তি একাডেমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর