ধর্ষন ও আইন

ধর্ষন! আধুনিক বিশ্ববাসীর কাছে আতঙ্ক,বর্বরচিত ও সামাজিক অবক্ষয়ের উদাহরণ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো বাংলাদেশেও এর সংক্রমণ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে মহামারি আকার ধারন করেছে। এই ঘৃণিত অপকর্ম থেকে মুক্তি পাচ্ছে না শিশুরাও।

গত ০৯/০৫/২০১৯ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ বছরের মে মাসের ১ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ৩৭টি মেয়ে শিশু ধর্ষণ এবং ৪টি ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল আরো ৩ জনের ওপর । ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ৩টি মেয়ে শিশু । আহত হয়েছে ৪১ শিশু।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (BSAF) আয়োজিত ‘শিশু অধিকার সুরক্ষা ও অগ্রগতি শীর্ষক’ সেমিনারে (১৫/০৫/২০১৯) বলা হয়, গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ মে পর্যুন্ত দেশের ১৫ টি দৈনিক পত্রিকা পর্যালোচনা করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৩৪৬ শিশু ধর্ষনের শিকার হয়েছে যেখানে ৩৮টি গণধর্ষনের শিকার। ধর্ষনের শিকার ৩৪৬ জনের মধ্যে ২২ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ধর্ষনের পর হত্যা করা হয় ১৮ জনকে এবং ১০ জন আত্মহত্যা করে। ধর্ষনের শিকার এক শিশুর বয়স মাত্র ২ বছর ৬ মাস!

গ্রাম বা শহরে রাস্তাঘাটে অথবা ঘরে কখনো আবার বাসে কিংবা লঞ্চে কোথাও নিরাপদ নয় আমাদের শিশু ও নারীরা। ঘরে ঢুকে বাবা-মা কিংবা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ, রাস্তায় ভাইকে বেঁধে রেখে বোনকে ধর্ষণ, বেড়াতে গেলে ফুঁসলিয়ে বা চকলেট দিয়ে বাচ্চাকে ধর্ষণ করা- এসব চিত্র যেন বেড়েই চলেছে। মূলত সামাজিক মূল্যবোধ,অবক্ষয়,ধর্মীয় ও সুশিক্ষার অভাব, নিচু মানসিকতা, বিচার হীনতার সংস্কৃতি কারণেই এর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অনেক সমাজবীদরা মনে করছেন। ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেভাবে এর প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ এখনো সমাজে কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই লোক লজ্জার ভয়ে, নিজের বা মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান কিন্তু এতে সমাজের বা ঐ পরিবারের কোনো লাভ হয়েই না বরং সমাজে ব্যাধিটির প্রভাব এবং প্রকোপ বেড়েই চলছে। ফলে একজন ধর্ষক খুব সহজেই হুমকি-ধামকি ও ভয় দেখিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে এবং এমন কাজ বারবার করার জন্য উৎসাহিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সকল নাগরিককে সামাজিক ভাবে সচেতন করার মাধ্যমে দেশ থেকে এই সামাজিক ব্যাধিটি বিরুদ্ধে তীব্র জন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেস্টা করলে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং আইনের মাধ্যমে ধর্ষকের প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করে দৃষ্টান্ত রাখতে হবে যেন, ভবিষ্যতে আর কেউ এসব অপরাধ সংগঠনের সাহস না করতে পারে।

কখন ধর্ষণ হয়েছে বলে ধরা হবে:
ধর্ষণ এক ধরনের যৌন আক্রমণ। সাধারণত,একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যাতিত তার সঙ্গে যৌন সঙ্গম বা অন্য কোনো ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ, অন্যভাবে চাপ প্রদান কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে। অনুমতি প্রদানে অক্ষম (যেমন-কোনো অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি) এরকম কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যৌন মিলনে লিপ্ত হওয়াও ধর্ষণের আওতাভুক্ত।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ (Penal Code 1860) আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের পাঁচটি ক্ষেত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই পাঁচটি ক্ষেত্রে কোনো শিশু বা নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করলে বা করার চেস্টা করলে সে ব্যক্তি ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে। ক্ষেত্র পাঁচটি হলো:
কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে;
কোন নারীর সম্মতি না নিয়ে;
কোন নারীকে মৃত্যু ভয় বা জখমের ভয় দেখিয়ে জোর পূর্বক সম্মতি আদায় করলে;
যদি কোন ব্যক্তি অবগত থাকে যে তিনি কোন নারীর আইনগত স্বামী নয় তথাপি তিনি ঐ নারীর স্বামী দাবি করেন এবং ঐ নারীর সম্মতিতে যৌনসঙ্গম করেন তবে উক্ত যৌনসঙ্গম ধর্ষন বলে বিবেচিত হবে;
চৌদ্দ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের সম্মতিতে বা অসম্মতিতে যৌনসঙ্গম করলে তা ধর্ষণবলে বিবেচিত হবে।

ব্যাখ্যা
ধর্ষনের অপরাধের ক্ষেত্রে অতি অল্প অনুপ্রবেশ করা হলেও যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে। এখানে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলতে প্রত্যক্ষ আগ্রহের অভাব বুজায়। ঘুমন্ত অবস্থায় বা নেশা গ্রস্থ করে বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি সম্পন্ন কোন নারীর সাথে যৌন মিলিত হলেও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলন করা হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। সম্মতি ছাড়া বলতে স্বাধীন ভাবে অনুমতি না দেওয়া বুজায়। মৃত্যুর ভয়ে বা আঘাতের ভয়ে সম্মতি দেওয়াকে সম্মতি দেওয়া বলা যাবে না। যদি কোন নারী কোন ব্যক্তিকে স্বামী হিসাবে ধরে নিয়ে তাকে সঙ্গমে সম্মতি দেয় এবং সম্মতিটি উক্ত ব্যক্তির মিথ্যা বর্ণনা দ্বারা অভিভূত হয়ে প্রদান করেন তাহলে উক্ত সম্মতিকে সম্মতি বলা যাবে না। একজন পতিতা বা বেশ্যা নারীও ধর্ষিত হতে পারে। তবে তা জোরাল সাক্ষী দ্বারা প্রমানিত হতে হবে। তার একার সাক্ষী যথেষ্ট হবে না। ব্যতিক্রমঃ কোন পুরুষ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করলে সেটাকে ধর্ষণ বলে ধরা হবে, যদি তার স্ত্রীর বয়স ১৩ বছরের কম হয়।

নজীর
আংশিক অনুপ্রবেশ যদি ও সতীচ্ছেদ ছিন্ন করতে যথেষ্ট হিসাবে গণ্য হয় না তবুও এটি একটি পূর্ণাঙ্গ অনুপ্রবেশ হিসাবে গণ্য হয়ে ধর্ষনের অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়।(এ আই আর ১৯৬২,কলকাতা, ৬৪১)।
নারী ধর্ষনের অপরাধের বেলায় কৌশলগত অনুপ্রবেশকে ও বুঝানো হয়েছে বলে অতি অল্প অনুপ্রবেশ করা হলে ও যথেষ্ট হিসাবে বিবেচিত হবে।(এ আই আর ১৯৬০,মাদ্রাজ, ৩০৮)।

ধর্ষিতার শরীরে ধ্বস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন না থাকলেই বলা যায় না যে ধর্ষন করা হয় নি (পিএলডি ১৯৬৬,করাচী, ১০১)
ধর্ষনের অভিযোগ প্রমাণ করতে হলে অভিযোগকারীকে যথেষ্ট পরিমাণ সমর্থনমূলক সাক্ষ্য দ্বারা উহা প্রমাণ করতে হবে (রাষ্ট্র বনাম আঃ আব্দুল খালেক) ১২ ডিএলআর ১৯৬০ (আপিল বিভাগ) ১৬৫।
ধর্ষিতা নারীর একক সাক্ষী ক্ষেত্র বিশেষে গ্রহনযোগ্য হতে পারে।(১৮ ডিএলআর, ৬৭)

ধর্ষন সম্পর্কিত আইন ও আইনের বিশ্লেষন ঃ
বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৭৬ নং ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি নারীকে ধর্ষন করে তবে তিনি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন কিংবা যেকোন বর্ণনার কারাদন্ডে-(যার মেয়াদ দশ বছর পর্যুন্ত হবে) দণ্ডিত হবেন একই সাথে অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। তবে ধর্ষিতা নারীটি যদি ঐ ব্যক্তির স্ত্রী হন এবং তার বয়স বার(১২) বছরের কম না হয় তবে সে ব্যক্তি যেকোন বর্ণনার কারাদন্ডে –(যার মেয়াদ দুই বছর পর্যুন্ত হবে) দন্ডিত হবেন বা অর্থদন্ডেবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৯ ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণের অপরাধে যে সকল শাস্তির বিধান রয়েছে তা হলো, যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ভয়ভীতি,অসম্মতি বা প্রতারণামূলক ভাবে সম্মতিতে যৌন সঙ্গম করেন তবে সেটি ধর্ষন বলে বিবেচিত হবে, উক্ত ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।
ধর্ষণের ফলে কোনো নারীবা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রমকারাদণ্ড এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যথায় এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দন্ডিত হবেন।

একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণ কালে বা ধর্ষণের পর যদি ধর্ষিতার মৃত্যু ঘটে বা আহত হন তবে উক্ত দলের সকলের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যথায় এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দন্ডিত হবেন। এই শাস্তি সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।

কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলেধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ দশ বছর এবং সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে।

পুলিশ হেফাজতে কোনো নারী বা শিশু ধর্ষিত হলে যাদের হেফাজতে থাকা কালে এ ধর্ষণ সংগঠিত হয়েছে তারা সকলেই নারী ও শিশুর হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য সর্বোচ্চ দশ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবংএর অতিরিক্ত কমপক্ষে দশ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দণ্ডিত হবেন। ধর্ষণকারী এক বা একাধিক ব্যক্তি হতে পারে। আবার ধর্ষণ না করেও কোনো ব্যক্তি ধর্ষণের ঘটনায় সাহায্য করতে পারে।
[ বিঃদ্রঃ একাধিক আইনের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হলে সর্বশেষ গৃহিত আইন কিংবা স্পেশাল আইন কার্যকর হবে ]
[*নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) একটি স্পেশাল আইন। অন্য কোন আইনের সাথে বিতর্ক সৃষ্টি হলে এই আইনটি অগ্রাধিকার পাবে]

ধর্ষিতা নারীর করণীয় কি?
প্রথমেই ধর্ষিতাকে প্রমাণ বা সাক্ষ্য সংরক্ষণ করতে হবে। ধর্ষণের ঘটনাটি দ্রুত বিশ্বস্ত কাউকে জানাতে হবে। কারণ তিনি আপনাকে সব ধরণের সহায়তা করেন এবং মামলার শুনানীর সময় সাক্ষ্য দিতে পারেন।
ধর্ষণ প্রমাণের গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স হলো ধর্ষণের শিকার নারীর শরীর। এ জন্য ধর্ষণের ঘটনার পর নিজেকে পরিষ্কার বা গোসল করা বা পরিপাটি থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ ধর্ষণকারী ধর্ষিত নারীর শরীরে কিছু না কিছু প্রমাণ রেখে যাবেই।
ঘটনার সময় যে কাপড় গায়ে ছিলো তা অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। কাগজের ব্যাগে করে কাপড় রেখে দিতে হবে। কাপড়ে রক্ত, বীর্য ইত্যাদি লেগে থাকলে তা যদি ধর্ষণকারীর রক্ত বা বীর্যের সাথে মিলে যায়, তাহলে মামলায় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসাবে কাজ করে।
যত দ্রুত সম্ভব থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিকটবর্তী থানায় এজাহার বা অভিযোগ দায়ের করুন। যদি সম্ভব হয় তবে একজন আইনজীবীকে সাথে নিতে পারেন।
পুলিশ কর্মকর্তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে চেষ্টা করুন। ঘটনার সময়ের আপনার পড়া কাপড় ও অন্যান্য সাক্ষ্য সাথে রাখুন। কারণ এসবই পুলিশ অফিসারের তদন্তের সময় কাজে লাগবে।

আপনি চাইলে ঘটনা সম্পর্কে মহিলা পুলিশ কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করতে পারেন।
মেডিক্যাল টেস্ট (৭২ ঘন্টার মধ্যে) দ্বারা নারীর শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য- প্রমাণাদি এবং আলামত সংগ্রহ করতে হবে, যা ধর্ষণের প্রমাণ ও ধর্ষণকারীকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে এবং পরবর্তিতে আদালতে পেশ করা যায়।
পুলিশ যদি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে কি করবেন?

থানায় অভিযোগ দায়ের করার পর পুলিশ যদি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তবে যত দ্রুত সম্ভব পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে (এস.পি অথবা ডি.সি) লিখিত ভাবে অবহিত করুন। তারাও যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাবে অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে অভিযোগ দায়ের করুন। ধর্ষনের ব্যাপারে শুধুমাত্র ধর্ষিতানারী নয়, তার পক্ষে যে কেউ অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। আপনি যত তাড়াতাড়ি থানায় অভিযোগ দায়ের করবেন, পুলিশ কর্মকর্তা তত তাড়াতাড়িই আপনাকে চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যাবেন। কারণ ধর্ষণের ৭২ ঘন্টার মধ্যে আলামত সংরক্ষণের পরীক্ষা না করালে ধর্ষণের আলামত গুলো সঠিক ও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এই পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে কিংবা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত যেকোন বেসরকারি হাসপাতালে করা যাবে। উক্ত পরীক্ষা হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার দ্রুত সময়ে ও যত্ন সহকারে সম্পন্ন করবেন এবং পরীক্ষার ফলাফল/রিপোর্ট সংক্রান্ত একটি সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রদান করবেন। উক্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পুলিশ দ্রুত ঘটনার তদন্ত শুরু করবেন। পরবর্তিতে ঐ তদন্ত রিপোর্ট বিচার কার্যের সময় পুলিশ বিচারকের সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে আদালতকে সাহায্য করবে।

সুপারিশ
সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের কারনেই ধর্ষন প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষন, ধর্ষনের চেষ্টা,ধর্ষনের পর হত্যাসহ নারী ও শিশুদের উপর যেভাবে যৌন নিপিড়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে তা দেশ, সমাজ তথা সবার জন্যই উদ্বিগ্নের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। এখনেই যদি ধর্ষনের বিপক্ষে উপযুক্ত ও সময় উপযোগী পদক্ষেপ না নিতে পারা যায় তবে ধর্ষন ও ধর্ষক উভয়েই নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে। যাঁহা আমাদের ভবিষ্যত ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত হিসাবে প্রতিফলিত হবে। তবে প্রচলিত আইনে অনেক দুর্বলতা আছে যা সঠিক ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থি। আবার অনেক আইন সময় উপযোগী না হওয়ায় বিচার কার্যে দীর্ঘসূত্রিতা ও দৃষ্টান্তমুলক বিচার করা সম্ভব হচ্ছে না যার ফলে অপরাধীরা আইনের ফাক-ফোকর ব্যবহার করে পার পেয়ে যাচ্ছে এবং আবার একই ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে।সুতরাং আইনের সংশোধন করে সময় উপযোগী ও যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ষনের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে দেশ থেকে ধর্ষনের মতো ঘৃণিত অপরাধ উৎখাত করা সম্ভব।

সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ অনুসারে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহন করা হয়। কিন্তু এ আইনের কয়েকটি ধারা অভিযোগকারীনির বিপক্ষে যায়। সাক্ষ্য আইন, ধারা ১৫৫(৪), বলা হয়েছে, ধর্ষক প্রমান করতে পারেন যে ধর্ষিত নারীর চারিত্রিক সমস্যা আছে। উক্ত ধারা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। সুতরাং অতিদ্রুত তা বাতিল করা দরকার। যদিও উক্ত আইনের ১৪৯ ও ১৫০ ধারায় বলা হয়েছে যে যুক্তি সঙ্গত কারণ ব্যতীত প্রশ্ন করা যাবে না বা করলেও আদালত তা গ্রহণ করবেন না বা আদালত উক্ত আইনজীবীকে সতর্ক করবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, ধারা ২০(৩) স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘মামলা প্রাপ্তির তারিখ হতে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু আমরা সবসময় দেখি যে, মামলা শেষ হতে এতো বেশি দিন সময় নেয় যে অভিযোগকারী বিচার পাওয়ার আশাই ছেড়ে দেয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, ১০১ ধারায় অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। উক্ত ধারার মাধ্যমেই ধর্ষনের প্রমাণ করতে হয় যেখানে বলা হয়েছে ধর্ষন মামলায়, বাদিনীর সমর্থহীন বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে কারো দন্ড দেওয়া যাবে না। অন্য সাক্ষী দ্বারা অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে বাদিনীর সমর্থনহীন সাক্ষের উপর ভিত্তি করে দন্ড দেয়া যায়। [(১৯৩৩) ৬২ ক্যাল. ৫৩৪; (১৯৩৭) ২ ক্যাল. ৩৪৫; (১৯৪৯) ২ ক্যাল. ১৮০; (১৯৪৫) নাগ, ২২৬ ]। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে ধর্ষন মামলার সাক্ষী একমাত্র ধর্ষিতা নারী বা শিশু। সুতরাং উক্ত ধারা সংশোধন না করলে ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে না ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) অত্যন্ত কঠোর একটি আইন। ফলে এ আইনকে ব্যবহার করে বিপুল হারে হয়রানি মুলক মিথ্যা মামলা দায়ের যেমন হচ্ছে, তেমনি এ আইনের অধীন শাস্তি পাওয়ার হারও খুবই কম। সময়ের সাথে অপরাধে ধরণ, মাত্রা ও পরিমান সবকিছুই পরিবর্তন ও বৃদ্ধি পেয়েছে। সময় হয়েছে আইন গুলো সংশোধনের মাধ্যমে সময় উপযোগী ও কার্যকারী করার। তবেই ধর্ষনের মতো ঘৃণিত ও বিকৃত কাজের জন্য দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে।

বার্তাবাজার /এইচ.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর