এই মাদ্রাসা শিক্ষকের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই

অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত পাঁচদিন একটানা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে চলে গেলেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত যৌন নিপীড়নকারী এবং জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনতে সারাদেশের মানুষ আওয়াজ তুলছেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেনীর সেই মাদরাসার সাবেক শিক্ষার্থী এবং সাপ্তাহিক এই সময়ের সহযোগী সম্পাদক স্বকৃত নোমান। নুসরাতের সাথে হওয়া ওই ভয়াবহ বর্বরতার কারণে পৃথিবীতে সিরাজের বেঁচে থাকার অধিকার নেই বলেও মনে করেন তিনি।

ফেসবুকে দেওয়া ওই স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

‘‘ফেনীর নুসরাত জাহান রাফির ঘটনায় আমার সেসব দিনের কথা মনে পড়ে গেল। রাফি যে ক্লাসে পড়ে আমিও সেই ক্লাসে পড়তাম। একই মাদ্রাসায়। সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা। বাধ্য হয়ে আমাকে মাদ্রাসায় পড়তে হয়েছিল। এদেশের ছেলেমেয়েদের অনেকে বাধ্য হয়ে মাদ্রাসায় পড়ে। তাদের কিছুই করার থাকে না। আমারও কিছু করার ছিল না।

তবে আমার ভাগ্যটা একটু ভালো, আমাকে কওমি মাদ্রাসায় (যাকে বলা হয় খারেজি বা হেফাজতি মাদ্রাসা) পড়তে হয়নি। আলীয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাপদ্ধতি এক নয়। বৃটিশরা ভারতবর্ষে যে ক’টি ভালো কাজ করেছিল তার মধ্যে আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ছিল অন্যতম।

ক্লাস ফোর পর্যন্ত আমি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। তারপর আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় মাদ্রাসায়। ক্লাস এইট পাস করার পর আমাকে চলে যেতে হয় সুদূর চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর জোষ্টপুরা গ্রামে। আমাদের বাড়ি পরশুরামের সীমান্তবর্তী বিলোনিয়ায়। বাড়ি থেকে এত দূরের মাদ্রাসায় ভর্তি করানোর পেছনে একটা কারণ ছিল। কৈশোরে আমি প্রায়ই সিনেমা দেখতে বন্ধুদের সঙ্গে সীমান্তের চোরাইপথে ইন্ডিয়ায় চলে যেতাম। ইন্ডিয়া মানে ত্রিপুরার বিলোনিয়া মহকুমা শহর। আমার পিতার আশঙ্কা ছিল, আমিও বুঝি গ্রামের কিশোর স্মাগলারদের মতো স্মাগলার হয়ে যাচ্ছি। সেই কারণে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া।

বোয়ালখালী থেকে দাখিল (এসএসসি) পাস করার পর একই কারণে বাড়ি থেকে ৩৫ কি.মি. দূরের সোনাগাজী মাদ্রাসার আলিমে (এইচএসসি) ভর্তি হতে হয়। ভর্তি হওয়ার মাসখানেক পরেই আমার ক্লাসের শিবির ক্যাডার শফিউল আযম আমাকে সেই রকম একটা মার দিয়েছিল। মারতে মারতে টেবিলের নিচে ফেলে দিয়েছিল। ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিতে চেয়েছিল। আমি দৌঁড়ে প্রিন্সিপালের রুমে পালিয়ে যাই। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। প্রিন্সিপালের সামনেই সে আমাকে মারতে থাকে।

আমার অপরাধ কী? অপরাধ হচ্ছে, আমি আমার ক্লাসের দেওয়ালে চিকা মারছিলাম, ‘খালেদা জিয়ার গুন্ডারা, হুঁশিয়ার সাবধান।’ কারণ, আমি তখন ফেনীর সাংসদ জয়নাল হাজারীর স্টিয়ারিং কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। জয়নাল হাজারীর আশীর্বাদপুষ্ট সোনাগাজীর চেয়ারম্যান মাস্টার শফিউল্লাহর সান্নিধ্যে থাকার ফলে আমার মধ্যেও স্টিয়ারিং প্রীতি তৈরি হয়। আমার সার্কেলটা গড়ে ওঠে স্টিয়ারিং কমিটির নেতা-কর্মীদের নিয়েই। সে কারণে আমি ছিলাম ছাত্রদল বিরোধী। বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে ক্লাসের দেওয়ালে চিকা মারতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ‘খালেদা জিয়া’ লেখা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই (গুন্ডারা, হুঁশিয়ার সাবধান লেখার আগেই) শফিউল আযম দেখে ফেলে। ক্লাসের দেওয়ালে আমি রাজনৈতিক চিকা মারছি! আমার এত বড় সাহস!

চিকা মারাই একমাত্র অপরাধ নয়। অপরাধ আরো আছে। শিবির ক্যাডাররা আমার উপর ক্ষিপ্ত ছিল আরও তিনটি কারণে। ১. আমি মাদ্রাসার পেছনে পুকুরের কোনায় দাঁড়িয়ে ছাত্রদের দেখিয়ে দেখিয়ে সেনরগোল্ড সিগারেট খাই। ২. ক্লাসরুমে যাওয়ার সময় পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে আমি সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক সিরিজের বই নিয়ে যাই। ৩. আমি একইসঙ্গে সোনাগাজী ডিগ্রি কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। মাঝেমধ্যে ক্লাস করতে কলেজেও যাই এবং স্টিয়ারিং কমিটির নেতা মামুনসহ কর্মীদের সঙ্গে মিশি। মূলত এই চার কারণে তারা আমাকে আচ্ছামতো একটা ধোলাই দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল। ধোলাই খেয়ে আমি তো কাহিল। ভাবলাম সোনাগাজী ছেড়ে চলে যাব। কিন্তু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আমাকে আঁকড়ে ধরলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আমার সব অপরাধকে (সিগারেট খাওয়া, সিনেমা দেখা, স্টিয়ারিং করা, গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়া) অনেকটা মেনে নিয়েছিলেন। মানতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ আমার পেছনে ছিলেন মাস্টার শফিউল্লাহ।

আমি জয়নাল হাজারীর স্টিয়ারিং কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, এটা নিয়ে আমার মধ্যে কোনো রকমের অপরাধবোধ নেই। আমি মাদ্রাসায় পড়েছি, এটা নিয়ে আমার মধ্যে কোনো রকমের হীনম্মন্যতা নেই। গৌরবও নেই। কেন নেই সে অনেক লম্বা কাহিনি। এসব কাহিনি আমি তোলা রাখছি। ভবিষ্যতে কোনো উপন্যাস কিংবা যদি কখনো আত্মজীবনী লিখি, তাতে লিখব। সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ঘটনায় এসব স্মৃতি মনে পড়ে গেল। রাফির সঙ্গে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা কী করেছে বা কী করতে চেয়েছে তা আমি দেখিনি। না দেখলেও আমার এতটুকু অবিশ্বাস হচ্ছে না। কারণ মাদ্রাসায় পড়ার সুবাদে মাদ্রাসা শিক্ষিত হুজুরদের খুব কাছ থেকে চিনি। এদের অধিকাংশই (খেয়াল করা দরকার, অধিকাংশই, অবশ্যই সবাই নয়) এতটাই বদমাশ যে, এদের বদমায়েশির ফিরিস্তি লিখে শেষ করা যাবে না। দুই হাজার পৃষ্ঠার একটা বই হয়ে যাবে। অবদমনের মধ্যে থাকতে থাকতে এদের মাথাটা পঁচে গলে নষ্ট হয়ে যায়। মেয়ের বয়সী ছাত্রীটিকে হয়রানি করেই সিরাজ উদদৌলা ক্ষান্ত হয়নি, পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে। কী ভয়াবহ! কী বর্বরতা। পৃথিবীতে সিরাজের বেঁচে থাকার অধিকার আছে বলে মনে করি না।’’

গত মার্চে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ‘শ্লীলতাহানির’ অভিযোগ এনে সোনাগাজী থানায় একটি মামলা করে নুসরাতের পরিবার।

গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফিকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মাদরাসার অধ্যক্ষকে আটক করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে।

এরপর মামলাটি তুলে না নেওয়ায় অধ্যক্ষ তার অনুসারীদের দিয়ে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালান বলে অভিযোগ। শরীরের ৮০ শতাংশের বেশি পুড়ে যাওয়া নুসরাত ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনায় রাফির মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।

বলা হয়, গত ৬ এপ্রিল (শনিবার) সকালে রাফি আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় যান। এ সময় মাদরাসার এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারধর করছে- এমন সংবাদ দিলে তিনি ওই বিল্ডিংয়ের চার তলায় যান। সেখানে মুখোশ পরা চার-পাঁচজন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। রাফি অস্বীকৃতি জানালে তারা তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।

দগ্ধ নুসরাত জাহান রাফি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে আজ না ফেরার দেশে।

এদিকে হাসপাতালে পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে নুসরাত বলেছেন, গত শনিবার সকালে ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রে আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বোরখা পরা চার নারী তাকে মামলা তুলে নিতে বলে। তাতে রাজি না হওয়ায় ওড়না দিয়ে তার হাত বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, মুখ ঢাকা থাকায় ওই চারজনকে চিনতে পারেননি। তবে এক পর্যায়ে তাদের একজন আরেকজনকে শম্পা নামে ডেকেছে, সেটা তার মনে আছে।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ভাইয়ের করা করা মামলায় ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজসহ আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি আসামিরা হলেন- পৌর কাউন্সিলর মাকসুল আলম, প্রভাষক আবছার উদ্দিন, সাবেক ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নূর উদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের। এছাড়া ঘটনার সময় ‘হাতমোজা, চশমা ও বোরকা’ পরিহিত আরও চারজনকে আসামি করা হয়েছে এ মামলায়।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর