সেই জমিলা কসাই পেলেন জয়ীতার সম্মাননা

চারপাশে ইট সিমেন্টের দেয়াল, মাথার ওপরে টিনের ছাউনি। দোকানের সামনে কোনো ঝাঁপ নেই। খোলা বা বন্ধ করার কোনো উপায়ও নেই। তাতে কি প্রতিদিন সকালে মাছি মারার ওষুধ দিয়ে দোকানটি মাছিমুক্ত করা হয়। কর্মচারীরা প্রতিদিন নিয়ম করে এই নির্দেশ পালন করেন।

দিনাজপুরের বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ী বাজারের কসাই তিনি। দিনে তিন-চারটি, শুক্রবারে আট-দশটি আর ঈদে ৬৫-৭০টি গরুর মাংস কেটে বিক্রি করেন। নিপুণ ব্যবসায়ী জমিলা বেগমের ক্রেতা পাশের নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও এমনকি পঞ্চগড়ের মানুষও।

ঝাড়– দিয়ে মুছে তাদের ঘর পরিষ্কার রাখেন। এই দোকানের মালিক জমিলা বেগম এখনো নিজে গিয়ে গরু কেনেন বাজারে। আগে দালালরা ভালো গরু চিনিয়ে দিতেন, কিন্তু ২০ বছরের টানা অভিজ্ঞতায় এখন গরুর গায়ে হাত দিলেই তিনি বুঝতে পারেন, সেটি সুস্থ নাকি কোনো রোগে আক্রান্ত। রোগাক্রান্ত গরু কোনো দিন শত অভাবেও কেনেননি তিনি। ফলে তার কোনো গরু কিনে আনার পর কখনো মরেনি। তারপরও তার শান্তি হয় না।

জমিলা নিয়ম করে তাদের দেবারু পাড়া গ্রামের গরুর ডাক্তারকে (পশু চিকিৎসক) দিয়ে প্রতিটি গরু রোগমুক্ত আছে কি না পরীক্ষা করান। গরু নিয়ে এসে ‘মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডারে’ পাশের খোলা মাঠে জমা করেন। সে জন্য বাজার কমিটির মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের খাতে গরু প্রতি ৬০ টাকা দিতে হয়। রাতে সেগুলোর পাহারায় থাকেন কর্মচারীরা, ছেলে জহিরুল ইসলামও ঘুরে দেখেন। ভোর সকালে জমিলা ওদের সঙ্গে বরাবরের মতো কথা বলেন। শেষ বিদায় নেন। সকালে বাজারের পাশের মসজিদের ইমামকে দিয়ে জবাই করান। তিনি গরু প্রতি পান ৪০ টাকা।

তিনি এক সময় ৪০ টাকা থেকে মাংস বিক্রি শুরু করে আজকের এ পর্যায়ে এসেছেন। বাজারের ১৫টি মাংসের দোকানের মাত্র চারটি তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে আছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তার এই সাফল্যের একমাত্র রহস্য ‘সততা’। জমিলা বেগম বলেন, ‘মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা করলে ক্ষতি হয়। তবে সৎ থাকলে ব্যবসায় সফলতা আসে।’ এখন এক টাকা না নিয়ে হাটে গেলেও শ-খানেক বা যত ইচ্ছা গরু নিয়ে ফিরতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন। তবে এখন তিনি সব সময় হাটে যেতে পারেন না। একমাত্র ছেলে ৩৩ বছরের জহিরুল ইসলাম ও কর্মচারীরা হাটে যান।

জমিলা বেগম এবার উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পেলেন জয়ীতা নারীর সম্মাননা। সোমবার দুপুর ১২টায় জমিলা বেগমকে দিনাজপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে সফল ক্যাটাগরিতে এই সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। এতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. সানিউল ফেরদৌস এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি জাকিয়া তাবাসসুম জুঁই, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দিনাজপুর পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন।
জয়ীতার সম্মাননা ক্রেস্ট পেয়ে বেশ খুশি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়বাড়ী এলাকার জমিলা বেগম। জীবন সংগ্রামে হারনামা এই নারী জয়ীতার সম্মাননা পুরস্কার পেয়ে বলেন, ‘আমাকে সাংবাদিকরাই আজকে সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমি দীর্ঘ দুই যুগ ধরে কসাইয়ের কাজ করে আসছি। আমার জীবন সংগ্রাম থেমে রাখিনি। যার জন্য আজকে আমি এই সম্মাননা পেয়েছি। এজন্য তিনি গণমাধ্যমকেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন।’

এছাড়াও আরো ৪ জন নারী পান জয়ীতার সম্মাননা। তারা হলেন, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিরামপুরের ফরিদা পারভীন, সফল জননীর ক্যাটাগরিতে ঘোড়াঘাট থেকে বাট লোমেয়া সরেন, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু ক্যাটাগরিতে খানসামা থেকে মোক্তারিনা বেগম, সমাজ উন্নয়নে অবদানের জন্য চিরিরবন্দর থেকে রাজিয়া সুলতানা।

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর দিনাজপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মোর্শেদ আলী খান বলেন, ‘আমরা এমন সফল নারীকে সম্মাননা দেওয়ার জন্য আনন্দিত। ¯্রােতের বিপরীতে চলা এসব নারী জীবন সংগ্রামে এক জলন্ত উদাহরণ। আমরা চাই প্রতি বছর এরকম জয়ীতা নারীদের সম্মাননা দিতে। এজন্য গণমাধ্যম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাহায্য প্রয়োজন।’

এবিষয়ে দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. সানিউল ফেরদৌস বলেন, ‘জমিলা বেগম জীবন সংগ্রামে এক জলন্ত উদাহরণ। নারীরা শুধু ঘরে নয়, ঘরের বাইরেও যে পুরুষের মতই কাজ করতে পারে এবং সেটা ভারী কাজ এটা প্রমাণ করেছেন জমিলা বেগম। জমিলা বেগমের মত নারীকে সম্মাননা দিতে পেরে আমরাও গর্বিত। তবে এসব নারীরা যেন সম্মাননা পেয়ে থেমে না জান সেদিকটাও দেখতে হবে।’

বার্তা বাজার/ডব্লিও.এস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর