লাইলাতুল কদর বা শবেকদর উম্মতে মোহাম্মদীর কদর বাড়িয়েছে। বলা যায়, উম্মতে মোহাম্মদীর কদর বাড়ানোর জন্যই আল্লাহতায়ালা লাইলাতুল কদর নুরনবীকে (সা.) হাদিয়া দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রাচীনতম তাফসির ও হাদিসের কিতাবগুলো সে তথ্যই জানাচ্ছে দুনিয়াবাসীকে। তাফসির সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থের একটি তাফসিরে মুজাহিদ। তাবেয়ি মুজাহিদ (রহ.) এ তাফসিরের বর্ণনাকারী বা সংকলকও বলা যায়। লাইলাতুল কদরের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি সুরা কদরের শানে নুজুল সম্পর্কে একটি হাদিস এনেছেন। আবু হাতেম ও ওয়াহেদির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ‘একদিন রসুল (সা.) সাহাবিদের নিয়ে আলোচনা করছেন। কথায় কথায় রসুল (সা.) বললেন, বনি ইসরাইলের যুগে একজন বড় বুজুর্গ ছিলেন। তিনি রাতভর নামাজ ও  তেলাওয়াতে ডুবে থাকতেন আর দিনভর নাঙ্গা তলোয়ার হাতে খোদার রাস্তায় জিহাদ করে কাটিয়ে দিতেন। এভাবে তিনি এক হাজার মাস ইবাদতে অতিবাহিত করেন।

এ ঘটনা শুনে বিস্ময়ে সাহাবিদের চোখ কপালে উঠে গেল। তারা আফসোস করে বললেন, ওই আবেদের তুলনায় আমাদের ইবাদত কত কম। আখেরি নবীর উম্মতের এ আফসোসটুকু আল্লাহ বরদাশত করলেন না। নবী ও তাঁর উম্মতের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গে সুরা কদর নাজিল করে জানিয়ে দিলেন, এ উম্মতের জীবনে প্রতি বছরই এমন একটি মহিমান্বিত রাত আসবে যে রাতের ইবাদতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি হবে।’ (তাফসিরে মুজাহিদ ও তাফসিরে তাবারি) মালেকি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মালেক (রহ.) তাঁর বিখ্যাত মুয়াত্তা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমি এক জ্ঞানীকে বলতে শুনেছি, উম্মতে মোহাম্মদীর হায়াতে দুনিয়া খুবই সামান্য। অন্যান্য উম্মত হাজার বছরও হায়াত পেত। তাই যুক্তি বলে, অন্যান্য উম্মতের চেয়ে উম্মতে মোহাম্মদীর ইবাদতের পরিমাণও হবে কম। কিন্তু এ যুক্তি টেকে না লাইলাতুল কদরের মতো অসাধারণ নেয়ামতের কল্যাণে। এ এক রাতের ইবাদত উম্মতে  মোহাম্মদীকে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে দেবে। (মুয়াত্তা মালেক) প্রখ্যাত মুফাসসির কাজি সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ.) তাঁর তাফসিরে ইমাম মুয়াত্তার হাদিসটি উল্লেখ করে বলেন, ‘সুরা কদর নাজিল হওয়ার যতগুলো শানে নজুল বর্ণিত হয়েছে তার মধ্যে ইমাম মালেকের বর্ণনাটিই সর্বাধিক সহি। এ বর্ণনাটি এ কথাও প্রমাণ করে, লাইলাতুল কদর উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য বিশেষ হাদিয়া। অন্য কোনো উম্মতকে এ ধরনের নেয়ামত দিয়ে ধন্য করা হয়নি। ইবনে হাবিব মালেকিও এ রকম বলেছেন। আর ইমাম শাফেয়ি (রহ.) তাঁর আল ইদ্দত গ্রন্থে এটিই অধিকাংশ আলেমের মত বলে মন্তব্য করেছেন।’ (তাফসিরে মাজহারি)

তবে ইমাম নাসায়ির একটি বর্ণনা আমাদের আলোচনাকে নাকচ করে দিতে পারে। তাই মাজহারির লেখক নাসায়ির হাদিসটি নিয়েও বিস্তারিত বলেছেন। তিনি বলেন, ‘লাইলাতুল কদর উম্মতে মোহাম্মদীর বিশেষ মর্যাদার প্রতীক- এ মতের বিপক্ষে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। নাসায়িতে সাহাবি আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একবার তিনি রসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! ফজিলতপূর্ণ কদরের রাত কি কেবল নবুয়ত ও রেসালাতের সঙ্গেই সম্পর্কিত? নবী-রসুলদের ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে কি এ রাতের মর্যাদা শেষ হয়ে যায়? জবাবে রসুল (সা.) বললেন, না। বরং কদরের ফজিলত জারি থাকে।

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত হাদিসবিশারদ আল্লামা ইবনে হাজার বলেছেন, পূর্ববর্তী উম্মতদের জন্যও লাইলাতুল কদর ছিল। আর ইমাম মালেকে বর্ণনাটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। জবাবে তাফসিরে মাজহারির লেখক বলেন, ইবনে হাজারের বক্তব্য এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং রসুল (সা.)-এর বাণী নবী-রসুলদের ওফাতের পরও লাইলাতুল কদরের ফজিলত জারি থাকবে- এ কথা দিয়ে বোঝানো হয়েছে হুজুর (সা.)-এর ওফাতের পর লাইলাতুল কদরের নেয়ামত বন্ধ হয়ে যাবে না। (তাফসিরে মাজহারি)।